'জেল হত্যাকাণ্ডের দিন বাঙালি জাতির জন্য ঘৃণ্য ও বর্বরতম'
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১২
'জেল হত্যাকাণ্ডের দিন বাঙালি জাতির জন্য ঘৃণ্য ও বর্বরতম'
এস এস রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নৃশংসভাবে হত্যার আড়াই মাসের মাথায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে (বর্তমানে জাদুঘর) হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড কলঙ্কজনক ও বেদনাদায়ক অধ্যায়।



১৫ আগস্টের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে কেন্দ্রীয় কারাগারের রাখা হয়েছিল। নিউ জেলের পাশাপাশি তিনটি রুমে তাঁদের রাখা হয়। ১ নম্বর ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আটজন বন্দি। ২ নম্বর রুমে ছিলেন এ এইচ কামারুজ্জামানসহ ১৩ জন। ৩ নম্বর রুমে ছিলেন এম মনসুর আলীসহ ২৬ জন। সেই রাতে ১ নম্বর রুমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে রেখে বাকি ছয়জন বন্দিকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ২ নম্বর রুম থেকে এ এইচ কামারুজ্জামান ও ৩ নম্বর রুম থেকে এম মনসুর আলীকে ১ নম্বর রুমে নেওয়া হয়। এই রুমেই তাঁদের চারজনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়।



স্বাধীন বাংলাদেশে চিরকাল যে দিনগুলো কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নভেম্বর। এর আগে ১৫ আগস্ট সপরিবার হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।


একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন জাতির সেরা সন্তান জাতীয় এই চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিল।


ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। কারাগারে থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।



জেলহত্যার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখলে রেখেছিল খুনিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষ। তারা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল হত্যা মামলার বিচার। সুপরিকল্পিতভাবে অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর মামলার প্রক্রিয়া আবার চালু করা হয়।



২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর নিম্ন আদালত থেকে মামলার রায় পাওয়া যায়। রায়ে তিনজনের মৃত্যুদণ্ডসহ ১৫ জনের সাজা হয়। এরপর মামলা যায় হাইকোর্টে, পাওয়া যায় হাইকোর্টের রায়; যদিও সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই পলাতক কিংবা বিদেশে অবস্থান করছে। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অপরাধে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। যেসব আসামি এখনো পলাতক, দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং রায় কার্যকরের মাধ্যমে ইতিহাসের আরেক কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে।


এ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বিবার্তাকে বলেন, জেল হত্যাকাণ্ডের দিন বাঙালি জাতির জন্য ঘৃণ্য ও বর্বরতম দিন। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং তাদের দোসররা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।



তিনি বলেন, '৭১ ও '৭৫ এর খুনিরা এখনো দেশে আছে। তারা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নিঃশেষ করতে চায়। তারা সরকারকে উৎখাত করে গণতন্ত্রকে পদদলিত করতে চায়। এরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতায় যেতে চাই। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের পুনরায় যুদ্ধ করতে হবে।



এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ঘটনা তো ৩ নভেম্বরই সূত্রপাত হয়েছে তা নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পরে খুনি খন্দকার মোশতাক যখন অবৈধভাবে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন সে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদের তার মন্ত্রিসভায় যোগ দান করানোর জন্য। সেটা অনেকাংশ সে করেছে তিনি সফল এবং সেই মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেকেই তার মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছে। কেউ কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেছে, অনেকেই চাপের মুখে গেছে, অনেককে ভয়ভীতি দেখিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা এবং তার সহকর্মী চারজন জেলের ভেতরে গেলেন। তারা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। সে কারণে তাদেরকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে গৃহবন্দি রাখা হল এবং বার বার বলা হল মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য। এমনকি খন্দকার মোশতাক তাদেরকে অনুরোধ করেছিল যোগদানের জন্য। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখান করেছে এবং বলেছে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এক চুল সরবো না।


তিনি বলেন, মোশতাক চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলেন, দেখেন যে আর কিছু করা যাবে না তখন তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হল। ১৫ আগস্টের সপ্তাহ খানেক পরেই জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার আটক রাখা হয়। তারপর থেকে ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ড এই পুরোটা সময় তার কারাগারে ছিলেন। পরে খন্দকার মোশতাককে যখন বঙ্গভবন থেকে বহিষ্কার করার কথা চলছিল এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী সেনা সদস্যদের বঙ্গভবন থেকে বের করে দেয়া হচ্ছিল। তখন তারা আরেক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মোশতাকের নির্দেশে ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে কারাগারে ঢোকার চেষ্টা করল। কারাগারে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা সেনাদের জানালেন জেল কোড অনুযায়ী সূর্য ডোবার পর থেকে সূর্য উদয় পর্যন্ত কারাগারের ফটক খোলার অনুমতি নেই। তখন সেনারা সেখান থেকে খুনি মোশতাকের সাথে যোগাযোগ করল তাদের হাতে সময় নেই। মোশতাক তখন অবৈধ রাষ্ট্রপতি কিন্তু তারপরও সে রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছে।


তিনি বলেন, ‘তখন খন্দকার মোশতাক জেল কর্তৃপক্ষকে যখন বলল যে, তারা যেভাবে বলছে তোমরা সেভাবে কাজ কর। তখন আর তাঁদের পক্ষে কারাগারের গেট বন্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। গেট খুলে দিতে তারা বাধ্য হল এবং গেট খুলে দেয়ার সাথে সাথে তারা সরাসরি চলে গেল চার নেতার রুমে। সেখানে আরও নেতৃবৃন্দ ছিল কিন্তু জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হল। যাদের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম তাদেরকে ব্রাশফায়ার করে সেনারা বেড়িয়ে আসে। তারা খুনিরা খুব তাড়াহুড়া করে বেড়িয়ে আসছিল। তখন ক্যাপ্টেন মনছুর আলী পানি পানি বলে চিৎকার করছিল। সেই শব্দ জেলের প্রহরী শুনে দৌড়ে গিয়ে চলে যাওয়া সেনাদের বলে ভেতরে শব্দ হচ্ছে। তখন সেনারা আবার জেলের ভেতরে গিয়ে সবার মৃত্যু নিশ্চিত করল।’


সাবেক উপাচার্য বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি মুক্তিযুদ্ধের নির্মাতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে ১৫ আগস্ট হত্যা করা হলো এবং তার আড়াই মাসের ব্যবধানে জাতীয় চার নেতা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অটুট ছিলেন তাদের হত্যা করা হল। হত্যা করেছে কারা ওই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরা। কারণ তারা হয়ত ভেবেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা করলে তার আদর্শ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যখন তারা দেখল যে জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এক সেন্টিমিটার সরে আসেনি। তখন তাদের হত্যা করে খুনিরা পরের দিন চলে গেল দেশের বাইরে।


তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার বিচার বহুদিন করা যায়নি। এসব বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ ২১ বছর পর প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় এসে এসব হত্যাকাণ্ডের দ্বার উন্মোচন করলেন। কারাগারে একজন হত্যাকারী সেও কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে বসবাস করার সুযোগ পায়। সেখানে আমরা এমন চারজনকে হত্যা করলাম যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন দেশ দিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা এ দেশের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর থেকে মর্মান্তিক ও জঘন্য ঘটনা আর কি হতে পারে।


আরেফিন সিদ্দিক আরো বলেন, জেল হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের একটি নৃশংসতম ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে সুদূরপ্রসারী হীন উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্র। দেশকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, দেশকে রাজনীতিহীন করার একটা অপচেষ্টা ছিল ঘাতকচক্রের।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com