স্কয়ার হাসপাতালে অবহেলায় শিশু এমিলিয়ার মৃত্যু
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৩, ২৩:১৪
স্কয়ার হাসপাতালে অবহেলায় শিশু এমিলিয়ার মৃত্যু
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

‘সরকারি হাসপাতাল থেকে দেশসেরা হাসপাতালে আনলাম। ওনারা বলল, বাচ্চার (এমিলিয়া) অবস্থা এত ক্রিটিক্যাল, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরপর এমিলিয়াকে আর দেখতে দেয় নাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমি কতবার নার্সদের বলেছি, যদি আমাদের দেখতে না দেন তাহলে জানান, বাচ্চাটার কী অবস্থা। কিন্তু ওরা জানায়নি। পরে আমি হাসপাতাল প্রশাসনের একজনকে খুঁজে বের করেছি। তার মাধ্যমে আমি বাচ্চার কাছে গিয়েছি। দেখি আমার বাচ্চাটা কান্না করতেছে আর বলতেছে, আমার মাকে এনে দাও, আমি আমার মার কাছে যাবো। নার্সগুলো ঘোরাফেরা করছে। তারা কিছু শুনছে না। পরে রাতের ওর শরীর অনেক খারাপ হয়ে যায়। এটা ওনারা আমাদেরকে জানায়নি। সকালে যখন আমি বাচ্চাকে দেখতে গিয়েছি, দেখি ও ট্রমায় মধ্যে আছে। মেয়ে আমার আমাকে দেখে চিনতে পারতেছে না। আমাকে বলতেছে, সিস্টার আমার মাকে একটু এনে দিবা। তখন আমার বাচ্চার পাশে কোনো নার্স ছিল না। ওর নাকে নল ছিল, হাতে ক্যানোলা ছিল না। স্যালাইন ছিল না। ও এমনিতেই পড়ে আছে। বাচ্চাটা ওই অবস্থায় খালি বলছে, আমার মাকে এনে দাও, আমার মাকে এনে দাও।’


বুকের গহীনে কান্না চেপে কথাগুলো বলছিলেন শিশু এমিলিয়ার মা চৌধুরী নুরজাহান মঞ্জুর সেতু।


গত ৩০ অক্টোবর, সোমবার রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে এমিলিয়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসক ও নার্সদের গাফিলতির কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।


মৃত শিশুর নাম এমিলিয়া মঞ্জুর রাজ চৌধুরী। তার মা চৌধুরী নুরজাহান মঞ্জুর সেতু একজন উদ্যোক্তা, বাবা পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর। তিনি নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং কলেজের উপ-অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত আছেন।



১০ বছরের শিশু এমিলিয়া। রাজধানীর হলিক্রস স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। ৩০ অক্টোবর, সোমবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মা চৌধুরী নুরজাহান মঞ্জুর সেতুর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায় তিনি বলছেন, 'আমার ছোট বাচ্চাটাকে তারা (স্কয়ার হাসপাতাল) মেরে ফেলছে'।



এ ব্যাপারে এমিলিয়ার মা চৌধুরী নুরজাহান মঞ্জুর সেতু বিবার্তাকে বলেন, গত শনিবার (২৮ অক্টোবর) আমরা পুলিশ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল থেকে ওকে ভর্তি করি স্কয়ার হাসপাতালে। তখন ওরা আইসিইউতে দেয়। ওর স্টমাক ব্লক ছিল। ও কিছু খেতে পারছিল না। হজম হচ্ছিল না। এই কারণে ওর পেট ব্যথা ও বমি হচ্ছিল। ভর্তি করার পর এখানকার চিকিৎসকেরা জানালেন, ওর সব জায়গায় ইনফেকশন ছড়িয়ে গেছে। ওর ব্লাডে ইনফেকশন ছড়িয়ে গেছে। ব্লাডে ইনফেকশন বেশি হওয়ায় কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই দুই কারণে ওর এত জ্বর ওঠে যে ও ট্রমায় চলে যায়।


হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘ওনাদের এখানে (স্কয়ার হাসপাতাল) আনলাম। ওনারা বলল বাচ্চার অবস্থা ক্রিটিক্যাল আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। রবিবার (২৯ অক্টোবর) দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বাচ্চাকে আমাদের দেখতে দেয় নাই। আমি কতবার নার্সদেরকে বললাম যদি আমাদের দেখতে না দেন তাহলে ওর অবস্থা জেনে আমাদেরকে জানান, বাচ্চটার কী অবস্থা। কিন্তু ওরা তাও করেনি।


তিনি আরো বলেন, পরে আমি খুঁজে ওদের প্রশাসনের একজনকে বের করেছি। তার সাহায্যে আমি পিআইসিইউতে ঢুকছি। ঢুকে দেখি আমার বাচ্চাটা কান্না করতেছে এই বলে, আমার মাকে এনে দাও, আমি আমার মার কাছে যাবো। আর নার্সগুলো ঘোরাফেরা করছে। পরে আমি বাচ্চার সঙ্গে কথা বললাম। কথা বলার পরে রাতের বেলায় ডাক্তাররা আমাকে ব্রিফিং দিল, আপনার বাচ্চার ইনফেকশনটা সারলেই আমরা সবকিছু করতে পারব। কোনো সমস্যা নাই। তখন আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই ভরসা আছে তো? তাহলে আপনারা কাজ করতে থাকেন। তখন ডাক্তার আমাকে বলেন, ভরসা না থাকলে তো আপনাদেরকে বলতাম না। তাহলে তো বলতাম বাচ্চা নিয়ে যান।


পরে রাতেরবেলা ওর শরীর অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এটা ওনারা আমাদের বলে নাই। সকালবেলা যখন আমি বাচ্চাকে দেখতে গিয়েছি, দেখি ও ট্রমায় চলে গেছে। ও আমাকে দেখে চিনতে পারতেছে না। আমাকে বলতেছে, সিসটার আমার মাকে একটু এনে দিবা। তখন আমার বাচ্চার আশেপাশে কোনো নার্স ছিল না। ওর নাকে নল ছিল, হাতে ক্যানোলা ছিল না। স্যালাইন ছিল না। ও এমনিতেই পড়ে আছে। বাচ্চা ওই অবস্থায় খালি বলছে, আমার মাকে এনে দাও, আমার মাকে এনে দাও- বলেন নুরজাহান।



এমিলির মা বলেন, তারপরে আমরা বলার পরে ডাক্তাররা দেখতে গিয়েছে। তখন ডাক্তারদের ওর বাবা বলল, আপনাদের যদি সমস্যা হয় তাহলে বলেন, আমরা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ওকে বাইরে নিয়ে যাই। তখন ডাক্তার বলল ঠিক আছে আমরা তাহলে প্রসেস করি। তখন ওরা কেস সামারি রেডি করছিল। কিন্তু কেস সামারি দেওয়ার আগেই বাচ্চার অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়- যেহেতু রাতের বেলায় তারা ট্রিটমেন্ট করে নাই। ওর অবস্থা এত খারাপ হয়ে যায় যে আমাদেরকে কিছু না বলে রোগীকে লাইফ সাপোর্টে দিয়েছে। বাচ্চাকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যত অত্যাচার আছে সব করেছে। ওর চেহারাটা দেখলেই বোঝা যায়।



নুরজাহান মঞ্জুর বলেন, ‘প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ডাক্তার আমাকে জানায়, আপনার বাচ্চা ইজ নো মোর। তখন আমি বললাম, নার্সরা যে আমাদের ডাকল না। বাচ্চাটা তো শারীরিক থেকে মানসিকভাবে বেশি দুর্বল ছিল। মাকে যে ডাকলেন না, আপনারা এটার জবাব দেন। কিন্তু তারা আমাকে কোনো জবাব দিতে পারে নাই। দুপুর ১২টার সময় ঘোষণা দিয়ে বলেন, বাচ্চা আর নাই। ওদের অনেক গাফিলতি ছিল। ডাক্তার কাদেরের তত্ত্বাবধানে ছিল রোগী, কিন্তু সেই ডাক্তার রোগীর কাছে ছিলেন না। নার্সরাও রোগীর আশেপাশে কেউ ছিলেন না।



শিশুটির পরিবার সূত্রে জানা যায়, জন্মের সময়ই খাদ্যনালী ব্লক ছিল এমিলিয়ার। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে হঠাৎ তার পেট ব্যথা ও বমি শুরু হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পরেও সমস্যা না কমলে সকালে হাসপাতালে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও এক্সরে করা হয়। তখন জানা যায়, তার খাদ্যনালী ব্লক হয়ে গেছে। এরপরই তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে শনিবার (২৮ অক্টোবর) তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই পিআইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।


হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিকিৎসক ও নার্সের গাফিলতির কারণে শিশু এমিলিয়ার মৃত্যু হয়েছে- মা চৌধুরী নুরজাহান মঞ্জুর সেতুর এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্কয়ার হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া যায় নি। ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি হাসপাতালে গিয়ে এবিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেও কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলেনি।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com