ডেঙ্গুতে বিপর্যস্ত শিশুরা, টিকা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে কতটা?
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৪:৫১
ডেঙ্গুতে বিপর্যস্ত শিশুরা, টিকা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে কতটা?
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছর সারাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারি আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক বেড়েই চলছে। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই ভয়ংকর হচ্ছে। আশঙ্কাজনকভাবে এ বছর রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন। এর মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য শিশুমৃত্যু বেড়েছে। এছাড়া শিশুরা তাদের অবস্থা বলতে ও বোঝাতে না পারায় বাড়ছে ঝুঁকি। তাই অবহেলা না করে শিশুর জ্বর বা যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) যৌথভাবে করা গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৭১ শতাংশ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে এক বা একাধিক বিপদসংকেত নিয়ে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: পাতলা পায়খানা, বমি, পেটব্যথা ও খিঁচুনি।


গত শনিবার গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে বলা হয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে এত বড় গবেষণা দেশে এর আগে হয়নি।


বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের ৮৭ শতাংশই ডেন-২ স্ট্রেইন (জিনগত ধরন) দ্বারা আক্রান্ত। বাকি ১৩ শতাংশ শিশু ডেন-৩ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।


গবেষণায় এ বছরের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৩৯ শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৭২২ শিশুর রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়। তাদের মধ্যে ১০৪ জনের রক্ত ও নাসিকা সোয়াবের নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়, শিশুরা কোন ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তা জানার জন্য।


এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী ড. কবিরুল বাশারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, ডেন২ এবং ডেন৩ এবার আমাদের কমিউনিটিতে সারকুলেশনটা বেশি। শুধু শিশু না সব মিলিয়েই ডেন২, ডেন৩ এ বছর বেশি। আর এতে শিশুদের মৃত্যুর হার বেশি থাকার কারণ হলো শিশুরা তো বলতে পারে না বোঝাতে পারে না। শিশুদের নানা রকম জটিলতা ও দুর্বলতা থাকে। সঠিক সময়ে যদি চিকিৎসা না পায় তাহলে শিশু, বয়স্ক এবং নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।


তিনি বলেন, ডেঙ্গুর যে চারটি সেরোটাইপ তা হলো ডেন১, ডেন২, ডেন৩, ডেন৪। এখন একেকটা সেরোটাইপ একেক বছর বেশি হয়। এ বছর ডেন২ ও ডেন৪ বেশি আর পাওয়া যাচ্ছে ডেন৩। এটা বোঝার কোন উপায় নাই, মানুষ বুঝতে পারবে না যে তার কোন সেরোটাইপ হয়েছে। কারণ এটা নরমাল টেস্ট করলেও বোঝা যাবে না। এটা পিসিআর টেস্ট করলে শনাক্ত করা সম্ভব, এটা কেউ করে না সাধারণত। এটা গবেষণার ক্ষেত্রে শুধু করা হয়। আর এটা রোগীর বোঝা এত জরুরি নয় আর বুঝেই বা কী করবে।


কবিরুল বাশার বলেন, নিজের বাড়ি এবং বাড়ির আঙিনা বা তার আশপাশে যাতে মশার প্রজনন না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হলে সাথে সাথে পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং তার পরামর্শ মেনে চলতে হবে।


ডেঙ্গু টিকা নিয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ চলছে। একটি টিকা সফল হয়েছে জাপানের কিউ ডেঙ্গা। ডব্লিওএইচও বিভিন্ন দেশে অনুমোদন দিয়েছে এ টিকা ব্যবহার করার জন্য। এটা আসলে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বিবার্তাকে বলেন, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু একেক বছর একেক ধরণ নিয়ে আসে। মালেসিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ডেন২ এর সাথে ডেন৩ হচ্ছে। ডেঙ্গুর সাধারণত চারটি ধরণ রয়েছে। ডেন১, ডেন২, ডেন৩, ডেন৪ অর্থাৎ প্রথম বার, দ্বিতীয় বার, তৃতীয় বার, চতুর্থ বার হচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশে ডেন২ বেশি হচ্ছে তার পাশাপাশি ডেন৩ হচ্ছে। যে কারণে শিশু ও বয়স্কদের সমস্যা বেশি হচ্ছে।


তিনি বলেন, ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পেতে প্রথমে রাষ্ট্রীয়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে ব্যক্তিগত অর্থাৎ আমার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে যারা স্কুলে যায় তাদের শরীরের সম্পূর্ণ অংশ যাতে ঢেকে যায়। অভিভাবকদের সবসময় বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। জ্বর-সর্দি এলেই দেরি না করে সাথে সাথে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে।


অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের কাছে এমন অনেক রোগী আসে যাদের দু-এক মাসের মধ্যে পরপর দুই-তিনবার ডেঙ্গু হয়েছে। তাদের দু-এক জনের অবস্থা অবনতি হলেও অনেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাই সবসময় মশা থেকে দূরে থাকতে হবে মশারি বা বিকল্প কিছু ব্যবহার করতে হবে। জ্বর এলে দেরি না করে পরীক্ষা করা ও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া। কেমিক্যাল ছাড়া ফলের রস খেতে হবে। অবশ্যই তা ঘরে বানানো হতে হবে।


দুই ধরনের শিশু রয়েছে বড় শিশু ও ছোট শিশু এমনটা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, ছোট শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে কারণ তারা বলতে বা প্রকাশ করতে পারে না। আবার বড়দের শরীরে পানি রিজার্ভ থাকে কিন্তু ছোটদের শরীরে পানি রিজার্ভ কম থাকে। বড়দের বললে তারা বুঝতে পারে যে পানি খেতে হবে বা খাবার খেতে হবে। কিন্তু ছোট শিশুরা বুঝতেও পারে না বোঝাতেও পারে না। তাই শিশুদের ডেঙ্গুতে ঝুঁকি বেশি।


ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে জানতে চাইলে ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। আমাদের দেশে জাপানি টিকা পরীক্ষামূলক দেওয়ার কথা চলছে। তবে তা সব বয়সী রোগীর জন্য না এবং দিতে হবে নির্দিষ্ট সময়। সামনে এর ফল দেখা যাবে এবং আস্তে আস্তে এর ব্যবহার বাড়বে।


প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ্ বিবার্তাকে বলেন, প্রথম কথা হলো ডেঙ্গু যে ভাইরাস তার চারটি সেরোটাইপ আছে ডেন১, ডেন২, ডেন৩, ডেন৪। প্রথমে যে আক্রান্ত হয় তা ডেন১ বা ডেন৩ আসবে না। ডেন২, ডেন৩, ডেন৪ একই ব্যক্তি যদি বার বার আক্রান্ত হয় তখন মারাত্মক হয়ে যায়। এবার দেখা যাচ্ছে ডেন২ টা বেশি পাওয়া যাচ্ছে তার মানে আগে তারা কিন্তু একবার আক্রান্ত হয়েছিল ডেঙ্গুতে। এখন দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার, চতুর্থবার হচ্ছে এই জন্যই সিরিয়াস হচ্ছে। ডেন২ সেরোটাইপ বেশি পাওয়া যাচ্ছে এবং এটি বেশি সিরিয়াস।


তিনি বলেন, যে কারণে ডেন২ বাচ্চাদের বেশি সিরিয়াস হচ্ছে। কারণ বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। যেমন দুই-এক বছরের বাচ্চা তার কমপ্লেনগুলোতো বুঝাতে পারে না। ভালো হাসিখুশি থাকা বাচ্চা শরীর ছেড়ে দিল। এটা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হয় যারা পিতা-মাতা আছেন তাদের দায়িত্ব শিশুর প্রতি যত্নবান হওয়া। যাদের সন্তান এ রোগে আক্রান্ত তারা বসে থাকবেন না চিকিৎসকের কাছে যান।


এ বছর ডেন২ তুলনামূলক বাংলাদেশে বেশি পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, এতে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে চলছে। এটা কিন্তু অন্য যে কোনো বয়সী মানুষের হতে পারে। বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে যারা বিভিন্ন রোগে ভোগেন ডায়াবেটিস, প্রেসার, হার্ট, কিডনি, ক্যান্সারের রোগী, গর্ভবতী নারী তার যদি ডেন২ তে আক্রান্ত হন তাদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেশি।


এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই নরমাল সর্দি-কাশি, জ্বর হলেই কালক্ষেপণ না করেই পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষায় যদি পজেটিভ হয় সে অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও চিকিৎসা নিবেন। পাত্তা দেয় না অনেকেই সামান্য জ্বর কি ডাক্তারের কাছে যাবো এরকম না করে আগেই যদি ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় চিকিৎসা নেওয়া হয় তাহলে জটিলতাগুলো এড়ানো সম্ভব। মৃত্যুর মিছিলের যে লোক সংখ্যা বাড়ছে তা কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ্।


ডেঙ্গু টিকা নিয়ে জানতে চাইলে এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, টিকা এখনো গবেষণার পর্যায়ে যদিও সীমিত আকারে জাপানের একটি টিকা কিউ ডেঙ্গা নাম যা ডাব্লিওএইচও অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এটা ছয় থেকে ১৬ বছর বয়সীদের জন্য। এ বয়সের উপরেও দেওয়া যায় না আবার নিচেও না। তার মানে ঢালাও করে সবাইকে দিতে পারছে না। আমরা এখনো তেমন কোনো কার্যকরী টিকা হাতে পায় নাই। কারণ ডেঙ্গু চার টাইপের হওয়ার কারণে এমন কোনো টিকা আসে নাই যে চার টাইপেই কাজ করে। এখনও এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলমান আছে।


অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ্ আরোও বলেন, টিকা আসার আগ পর্যন্ত আমাদের প্রতিকার করতে হবে অর্থাৎ মশার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। বিশেষ করে বয়স্ক ও বাচ্চাদের প্রতি সবসময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com