মানুষ মরণশীল। নশ্বর জীবনের মায়া ত্যাগ করে একদিন পরপারে যেতেই হয়। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু জীবনাবসানের স্বাভাবিক নিয়মের আগেই কেন তাকে মরতে হবে? কেন বেছে নিতে আত্মহননের পথ? জীবন কি কখনো এতটা মূল্যহীন হতে পারে? অবশ্যই না! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাতেই এবার বলতে হয়, "মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই"
এ কথাতেই বাঁচার প্রবল আকুতি, বেঁচে থাকার খুব সূক্ষ্ম কারণটি স্পষ্টভাবে বোঝায়। অথচ কিছু মানুষের কাছে এ পার্থিব জীবন— বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে যায়। ফলে তারা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
যান্ত্রিক জীবনের বাঁকে বাঁকে খুব ধীরে এই আত্মহত্যার সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এবার একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে, সোমবার (২১ আগস্ট) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের শিক্ষার্থী শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম হলের ১৬৫ নম্বর রুমে আত্মহত্যা করেন। বেশ কিছুদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন তিনি।
রবিবার (২০ আগস্ট) একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী ঋতু কর্মকার নিপা (২৩) বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। মাস্টার্স সম্পন্ন করেও চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছিল না বলে, বেশ কিছু দিন থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। পরে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন।
এরআগে বুধবার (১৬ আগস্ট) সকাল পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হোস্টেলে জয়া কুন্ডু (২৪) নামে এক মেডিকেল শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সব একাডেমিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়া এই মেধাবী শিক্ষার্থী ঢামেক ছাড়াও বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে বিষণ্নতায় তার শেষ রক্ষা হয়নি।
গত ৯ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয় তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নওরীন। পারিবারিক কলহের জেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় পুলিশ।
উপরে উল্লেখিত কয়েক শিক্ষার্থী নয়, প্রতিদিনই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার খবর আসছে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ২৩৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বিবার্তাকে বলেন, প্রতিদিনকার গণমাধ্যম পর্যালোচনা করে তারা এই তথ্য পেয়েছেন। আগামী মাসে তারা এই বিষয়ে বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করবেন।
তিনি বলেন, নানা কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছেন। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পারিবারিক কলহ, পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না করতে পারা, আর্থিক সংকট, চাকরি না পাওয়া, প্রেমে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে বিষণ্নতায় ভোগেন। এক পর্যায়ে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
মোহাইমিনুল ইসলাম নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, প্রতি বছর যে হারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে, সে অনুপাতে তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরি পাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এছাড়া কোভিড পরিস্থিতি তাদের মাঝে হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকের চাকরির বয়সসীমাও চলে গেছে। ফলে অনেকে হতাশ হতে হতে জীবনের মায়াও ত্যাগ করছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেড়ে যাওয়া আত্মহত্যার বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে যখন মানুষ আর কোনো আশার আলো দেখতে পায় না, তখনই আত্মহত্যা করে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, ব্যক্তিভেদে আত্মহত্যার কারণ ভিন্ন হতে পারে। তবে মোটাদাগে এই ঘটনার জন্য বিষণ্নতা ও হতাশা দায়ী। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতার মূল কারণও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বিবার্তাকে বলেন, আমাদের ইয়াং জেনারেশন পড়াশোনা, চাকরিসহ বিভিন্ন কারণে হতাশ হয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে নিজেদের হতাশার বিষয় শেয়ার করতে হবে প্রিয়জনদের সাথে। আর পরিবার কিংবা অভিভাবককে অবশ্যই তাদের পাশে থাকতে হবে। তারা হতাশ হলে পরিবারের দায়িত্ব হলো তাদেরকে বলা, তুমি এতো চাপ নিও না, আমরা তো আছি। দেখো, চেষ্টা করো। ভালো কিছু হবে। একসময় না, একসময় তুমি সফল হবে। চিন্তার কিছু নেই। এভাবে পাশে থেকে পারস্পরিক শেয়ার করলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
তিনি বলেন, নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজের পরিবারকে ভালোবাসতে হবে। পরিবারের কথা মাথায় রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। আমি যেমন সমস্যায় আছি, অনেকে আরও বড় সমস্যায় আছে, এটা মাথায় রাখতে হবে। সমস্যা যেমন আছে, তার সমাধানও আছে, এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
হতাশার উত্তরণে করণীয় প্রসঙ্গে এ মনোবিজ্ঞানী বলেন, মনের দুঃখ-কষ্ট কাছের মানুষের সাথে শেয়ার করতে হবে। এরপরেও কোনো সমাধান না হলে মানসিক চিকিৎসা করাতে হবে। কোনোভাবে মনোবল হারানো যাবে না।
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. সারাহ খান বিবার্তাকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা ভোগবাদিতা, দারিদ্র্য, কর্মবিমুখ শিক্ষা, পারিবারিক দূরত্ব, এক কেন্দ্রীভূত শিল্পায়ন, ধর্মীয় চর্চার অভাব ইত্যাদি কারণে হতাশায় ভোগেন। এ হতাশা কারো একটু কম, আবার কারো বেশি হয়ে বিষণ্ণতা পর্যন্ত চলে যায়। এক পর্যায়ে অনেকে নিজেকে আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত ও কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরাই আমাদের আগামীর ভবিষ্যত। সে বিষয়টি মাথায় নিয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে।
বিবার্তা/রাসেল/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]