আগামী ৩০ বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়বে ৭ গুণ
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ২১:১৩
আগামী ৩০ বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়বে ৭ গুণ
রোজিনা রোজী
প্রিন্ট অ-অ+

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। এর ভয়ংকর প্রভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে দেশের উপকূল ও হাওরাঞ্চলের মানুষ। বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। মানবেতর জীবনযাপন করছে শিশুরা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়বে ৭ গুণ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বহু আগে থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।


সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। যেখানে রয়েছে দেশের প্রায় সব হাওর। হাওরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস।এই অঞ্চল সারা দেশের মৎস্য চাহিদার ২০ ভাগ ও ধানের ১৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধুঁকছে গুরুত্বপূর্ণ এই জনপদ।


পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে হাওর, জলাশয় ও জলাভূমি রয়েছে ৪১৪টি। জলমহাল রয়েছে ২৮ হাজার। বিল রয়েছে ৬ হাজার ৩০০। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর। ভাটির দেশ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে রয়েছে ১৩৩টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে চারটি, কিশোরগঞ্জে ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে তিনটি হাওর।


সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলায় এসব হাওর, জলাভূমি ও জলাশয়ের অধিকাংশের অবস্থান। এসব জেলাধীন এলাকাগুলোকে বলা হয় হাওরাঞ্চল। এর বাইরেও সব জেলায়ই ছোট-বড় বিল, জলাশয়, জলাভূমি রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে যা দেশের এক-পঞ্চমাংশ। এখানকার কৃষি উৎপাদন ও মৎস্যের পরিমাণ জনসংখ্যা অনুপাতে উদ্বৃত্ত।


স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হয় দেশের অন্য জেলাগুলোতেও। মূলত এটি এক ফসলি এলাকা। বছরের ছয় মাস হাওরাঞ্চলে থাকে শুধু পানি আর পানি। বাকি ছয় মাসে জমিতে ফলানো হয় একমাত্র ফসল ধান। কিন্তু অকাল বন্যায় প্রায়ই ধান তলিয়ে যায় পানির অতলে।


বিশেষজ্ঞরা জানান, জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার, শুকনো মৌসুমে জলমহাল পানিশূন্য করে রাসায়নিক ও নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরা, কীটনাশক ব্যবহার, অভয়াশ্রমের অভাব ইত্যাদি কারণে হাওরের মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে সেতু, বাঁধ ও সড়ক নির্মাণের কারণে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সহজেই বন্যা হচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে ফসল। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে হাওরা ও সেখানকার বাসিন্দারা।


এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলের হাজার হাজার পরিবার। দেশের দক্ষিণাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ প্রভাব না পড়লেও রাজধানীসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুরা ভিড় জমাচ্ছেন দেশের মধ্যাঞ্চলে।


প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো ভয়াবহ সংকটে পড়ছে। একটা দুর্যোগ কাটিয়ে না উঠতেই আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে উপকূলবাসীর স্বপ্ন তছনছ করে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলের মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে। উপকূলের শত শত পরিবার কাজ হারিয়ে, নদীভাঙনের শিকার হয়ে, সুপেয় পানির সংকটে বেঁচে থাকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে।


জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষত বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শিশুদের। নানা রোগ-বালাই হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে ভুগতে থাকা পরিবারগুলো যখন অর্থকষ্টে, খাদ্য সংকটের কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জীবনের তাগিদে এসব পরিবার পাড়ি জমাচ্ছে অন্যত্র। ঘূর্ণিঝড়, খরা, নদীভাঙন, বন্যা, লবণাক্ততা, সুপেয় পানির সংকট, জলোচ্ছাস, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি উপকূলের জীবনব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে।


সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনার উপকূলীয় এলাকায় জনসংখ্যা তুলনামূলক কমে যাচ্ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার উপকূল ছাড়ছে। এসব পরিবার জেলা, বিভাগ ও রাজধানীমুখী হচ্ছেন।


আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ‘অ্যাকশন এইড’ এবং ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়া’ তাদের এক যৌথ জরিপ শেষে সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা আগামী ৩০ বছরে ৭ গুণ বেড়ে যাবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আরো ৩০ লাখ মানুষ তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। গবেষণার ফলাফলে আরো বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ও ভয়াবহ প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে হবে এশিয়ার দেশগুলোর ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে।


বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারাবে। বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর ৪ লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিচ্ছেন। এ সংখ্যা প্রতিদিন দুই সহস্রাধিক। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু। যে শিশুরা উদ্বাস্তু হয়ে পরিবারের সঙ্গে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে, নতুন পরিবেশ, নানা সংকটে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে তাদের জীবন। জলবায়ু উদ্বাস্তু এসব শিশু মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।


যে কারণে বাড়ছে শিশু শ্রমিক। অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে লিপ্ত হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। অনেক শিশু শিক্ষার অভাবে বিপথে চলে যাচ্ছে। উপকূলের শিশুদের সংকটের মধ্যে রেখে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা কি সম্ভব, এমন প্রশ্ন সমাজবিজ্ঞানীদের। এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে এর পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত। জলবায়ু পরিবর্তনে শিশুদের কোনো হাত নেই, কিন্তু শিকার হচ্ছে তারাও।


উন্নত বিশ্বের কার্বন নির্গমনে ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তু জীবন গ্রহণ করতে হচ্ছে তাদের। উদ্বাস্তু শিশুদের শনাক্ত করে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে যে-সব প্রকল্প বা কার্যক্রম চালু আছে, সেগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।


এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক আরো বলেন, উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশকে বিধ্বংসী ও ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন করে তুলবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সারাবিশ্বকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে। অন্যথায় আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।


বিবার্তা/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com