শিরোনাম
ভাষার কৌতুক
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৩২
ভাষার কৌতুক
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

যে কোনো বিবেচনায় মোবাইল ফোনের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে কবি নির্মলেন্দু গুণের উদ্ভাবিত ‘মুঠোফোন’ শব্দটি এক কথায় অসাধারণ। কে জানি এটার নাম ‘চলভাষ’ও প্রস্তাব করেছিলেন। মনে পড়ে গেল, শুনেছি, সত্যজিৎ রায় dictionary শব্দের বাংলা করেছিলেন ‘দেখাশোনারি’, impossible-কে করেছিলেন ‘আম পচে বেল’। কিন্তু চলেনি।


তবে শুরুতেই বলে নিতে চাই, অপ্রমিত মানে অশুদ্ধ- এটা আজ পর্যন্ত কেউ দাবি করেননি। দাবি করাটা জরুরিও নয়।


শব্দের অর্থ না পাল্টিয়ে শব্দের বানান পাল্টানো অনেকটাই দস্তুর। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের নাম The Tragedie of Hamlet থেকে The Tragedy of Hamlet হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রথম ফোলিও থেকে দ্বিতীয় ফোলিও, ১৬২৩ থেকে ১৬৩২; মাত্র ক'টা বছর। কোয়ার্টোতে অবশ্য নাম ছিল The Tragicall Historie of Hamlet। সেই হ্যামলেটেই প্রায় শুরুর দিকে ছিল Doth make the night ioynt labourer with the day; আমরা এখন পড়ি Doth make the night joint labourer with the day; আর মার্কিনি ছাপায় Doth make the night joint laborer with the day। কে বলে বানান পাল্টানো যায় না বা পাল্টায় না? আর স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ১৭৮৯-এর The Rime of Ancyent Marinere ১৮১৭-তে এসে The Rime of the Ancient Mariner, তার জীবদ্দশাতেই।


ভাষাও মাঝে মাঝে জম্পেশ কৌতুক করতে পারে। অর্কিডের কথাই ভাবুন। বাগানবিলাসীরা হয়তো অর্কিডের নামে পাগল! গ্রিক orchis থেকে আসা শব্দটির মূল অর্থ ‘অণ্ডকোষ’। এটা ফুলের মর্যাদা পেয়েছে ১৮৪৫ সালে। তখন থেকে এটা হালের অর্কিড নাম পায়। মধ্যযুগের ইংরেজি ভাষীরা অর্কিডকে বলকওয়ার্ট বলতো। এই বলকওয়ার্ট শব্দটি এসেছে bullocks থেকে। আর bullocks মানেও অ-কোষ। প্রাচীন ইংরেজিতে আধুনিক balls শব্দটি beallucas নামে পরিচিত ছিল। আভোকাডো ফলটি হালে বাংলাদেশেও পরিচিতি পাচ্ছে। আঠারশ শতকে স্পেনিয়ার্ডরা এই ফলটির নাম স্পেনিশ aquacate শব্দ থেকে নেন। আবার স্পেনিশরা aquacate শব্দটি ধার নিয়েছে মেক্সিকোর ahuakati থেকে, যার অর্থও বাংলায় অণ্ডকোষ। ফলটির বীজের গঠন থেকে আজটেকরা এটার নাম ahuakati বা অণ্ডকোষ রাখে।


ইংরেজি pencil শব্দটির কথাই ভাবুন। এটার মূলানুগ অর্থ উটের পশম থেকে তৈরি শিল্পীর নরম তুলি। pencil শব্দটি চৌদ্দশ শতকে ফ্রেঞ্চ pincel থেকে নেয়া হয়। অবশ্য pincel শব্দটি এসেছে লাতিন penicillus থেকে, যার অর্থ রংতুলি বা পেনসিল। তবে আক্ষরিক অনুবাদে penicillus অর্থ ‘ছোট লেজ’। আর লাতিনে বাংলা ‘শিশ্ন’ শব্দটিকে সংক্ষেপে লেজ বলা হতো। অর্থাৎ পেনসিল শব্দের মূলানুগ অর্থ শিশ্ন। বাংলায় প্রচলিত সংস্কৃত কস্তুরী শব্দটির সমতুল শব্দ ইংরেজিতে musk। musk শব্দটি সংস্কৃত ‘মুষ্ক’ শব্দেরই বিবর্তিত রূপ। সংস্কৃতে মুষ্ক অর্থ অণ্ডকোষ।


ইংরেজিতে প্রিজারভেটিভ (preservative) শব্দটির অর্থ হল ‘সংরক্ষণ’। কিন্তু ফ্রান্সে এ শব্দটির অর্থ হলো ‘কনডম’। ইংরেজিতে পিক (pick) শব্দের অর্থ হল ‘বাছাই’। নরওয়েতে এর অর্থ হলো ‘শিশ্ন’। ইংরেজিতে ফিটার (fitter) অর্থ যে দর্জি মাপ মতো কাপড় কাটে। কিন্তু নরওয়েজিয়ান ভাষায় এর অর্থ হলো ‘নারীর যৌনাঙ্গ’। ইংরেজিতে পীচ (peach) শব্দের অর্থ হলো পীচ ফল। কিন্তু তুরস্কে এ শব্দটির অর্থ ‘জারজ’। ইংরেজিতে গিফট (gift) শব্দের অর্থ হলো উপহার। কিন্তু জার্মানিতে এর অর্থ হলো বিষ। তাই জার্মানদের কাছে ‘গিফট’ না চাওয়াই ভালো।



ইংরেজিতে salsa হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ নাচের ভঙ্গি। কিন্তু কোরিয়ান ভাষায় এর অর্থ ডায়রিয়া বা পেটের অসুখ। ইংরেজিতে বাম্প (bump) অর্থ আচমকা। কিন্তু সুইডিশদের কাছে এর অর্থ মনমরা ভাব। ইংরেজিতে কিস (kiss) শব্দটির অর্থ চুম্বন। কিন্তু আপনি যদি সুইডেনে এ শব্দটি কাউকে বলেন তাহলে পাবলিক আপনাকে টয়লেট দেখিয়ে দিবে। কারণ সুইডেনে কিস শব্দের অর্থ ‘মূত্রত্যাগ’। ইংরেজিতে বিল (bill) শব্দটির একটি অর্থ ‘নিতম্ব’। ইংরেজিতে কুল (cool) অর্থ শীতল। কিন্তু স্পেনে এর অর্থ ‘নিতম্ব’।


পাবলিকের সামনে একটু ভাব দেখানো আর গোমড়ামুখো লোককেই আমরা মুডি বা দেমাগি বলি। অথচ ১৬ শ শতকে মুডি বলতে বোঝানো হত সাহসী মানুষকে! আর্টিফিশিয়াল শব্দটি দিয়ে এখন নকল বা বানানো কিছুকে বোঝানো হলেও ১৪ শ’ শতকে ‘খুব বিদ্বান’ বোঝাতো। এমনিভাবে ১২ শ’ শতকে নাইস বলতে বোঝানো হত বোকাকে। ১৪ শ’ শতকে যত্নবান আর ১৮ শতকে বর্তমান অর্থ ধারণ করে শব্দটি।


ইংরেজি ভাষায় বানানবৈচিত্র্যের প্রমাণ প্রদর্শন করতে গিয়ে George Bernard Shaw একবার লিখলেন Ghoti, উপস্থিত সকলে এটাকে উচ্চারণ করলেন ‘ঘটি’। কিন্ত Bernard Shaw বললেন, ‘না, আমি লিখেছি Fish. তারপর তিনি বাতলে দিলেন- Laugh শব্দের বানানে gh এর উচ্চারণ হচ্ছে Gd. Women শব্দের বানানে o এর উচ্চারণ হচ্ছে ‘আই’। আর Nation শব্দের বানানে ti এর উচ্চারণ হচ্ছে ‘শ’। অতএব Ghoti শব্দটির উচ্চারণ হচ্ছে Fish।’ উপস্থিত সকলে একেবারে থ বনে গেলেন।


এবার বাংলা পর্ব। শুরুতেই একটা সরেস কৌতুক:


প্রধান শিক্ষক: পণ্ডিত মশাই, গতকাল স্কুলে আসেননি কেন?


পণ্ডিত: মহাশয়! কেলিকুঞ্চিকাকে নিয়ে দ্বারিকালয় গিয়েছিলাম।


প্রধান শিক্ষক: কোথায় গিয়েছিলেন?


পণ্ডিত: এ প্রশ্ন আমি করলে আপনি বলতেন, শ্যালিকাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম।


প্রধান শিক্ষক: আপনি এত কঠিন করে বললেন কেন? অবোধ্য ভাষায় কথা বলা ঠিক নয়।


পণ্ডিত: মহাশয়, মাফ করবেন। শ্যালিকা আর কেলিকুঞ্চিকা এক অর্থ বহন করে না। স্ত্রীর সহোদর ছোটবোন কেলিকুঞ্চিকা। শ্যালিকা বললে স্ত্রীর সহোদর বোনসহ চাচাত-মামাত-ফুফাত এমনকি পাড়াত বোনদেরও বুঝানো হয়। আমি আপনার সাথে তো যেমন তেমন কথা বলতে পারি না।


প্রধান শিক্ষক: দ্বারিকালয় অর্থ কী?


পণ্ডিত: গণ্ডমূর্খদের ভাষায় শ্বশুরালয়।


প্রধান শিক্ষক: কী? আমি গণ্ডমূর্খ!


পণ্ডিত: রাগেন কেন? শ্বশুরালয় মানে শ্বশুরের আলয়। সেখানে অন্য কেউ নাও থাকতে পারেন। কিন্তু দ্বারিকালয় এমন একটি আলয় যেখানে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাদের সন্তান-সন্ততি ও অন্যান্য পরিবারপরিজন নিয়ে থাকেন।



ছোটবেলায় শুরুতে ‘ক’ অক্ষর দিয়ে তৈরি শব্দরাশি নিয়ে কৌতুক করে বলতাম: কলিকাতার কবিভাবাপন্ন, কাব্যানুরাগী কানাই কর্মকারের কাজলাঞ্জন কনিষ্ঠা কন্যা কামিনী কর্মকার, কপাল কুঞ্চিত করে, কঙ্কন কচলিয়ে, কাকা কেদার কর্মকারকে কানে কানে কোমল কণ্ঠে কহিলো, কাকা কুঞ্জে কৃষ্ণকালো কোকিল কাকুতি করিতে করিতে কুহু কুহু করলেও কলিকাতার কতিপয় কালো কাক, কোকাতে কোকাতে কোন কারণে কুলক্ষণে কা-কা করে? কোন কালের কাকেরা কা-কা করে কাকে কাকা কইছে? কুহেলী কাকেদের কাকা কে? কটুভাষী, কৃপণ কেদার কাকা কটাক্ষে কটমট করে কইলেন- কন্যা, কপাল কুঞ্চিত করতেছো কেনো? কোকিল কুহু কুহু করলে, কাকও কা-কা করবে, কেননা কা-কা করাই কাকের কাজ, কাজেই কাক কা-কা করে। ক্লিষ্ট কাকের কপালে কা-কা করাই কঠিন কর্তব্য। কাকেদের কাকা কোনো কালেই কেহ না।’ বাংলায় আরেক গ্রাম্য-বচনে রয়েছে: চান্দু চাচা চা চায় চাচী চেইত্তা চুলায় চা চড়ায়, চান্দু চাচা চা চায়।


অথবা স্মরণ করুন সেই গ্রামীণ ধাঁধা: ‘হাতিশূঁড়ার মায়ের মাঠে তিন ভিরিঙ্গার ডালে প্রভুরে বানাইয়া রাখছে, রস পড়ে তার নালে’ অর্থাৎ দুর্গাপুরের মাঠে একটা বেল গাছের ডালে একটা পাঁঠা ঝুলিয়ে রেখেছে, তা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।


অতি নম্রতা প্রদর্শনের জন্যও শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে যায়। যেমন নিজের বাড়ি হলে ‘গরীবখানা’, পরের হলে ‘দৌলতখানা’, দেবতার জন্য খাদ্য নয় ‘ভোগ’, দেবতাকে দেখা নয় ‘দর্শন’। এক খ্যাতিমান লেখকের লেখায় ক্ষুব্ধ গৃহকর্তা তার গৃহকর্মীকে বলছেন, ব্রিটেনের রানী ‘আহার’ করেন, বর্ধমানের রাজা ‘ভোজন’ করেন, আমি ‘খাই’ আর তুই ‘গিলিস’।


শেষে একটা কৌতুক শুনুন। ক্লাসের মেধাবী ছাত্র ফাহিম লিখল ‘যুদ্ধে হারিয়া হুমায়ুন ভাঙ্গিয়া পড়িলেন না। তিনি পিতা ও গুরু বাবরের কথা স্মরণ করিলেন। বাবর কি যুদ্ধে হারিয়া কখনও ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন? পড়েন নাই। বরং উল্লসিত হইয়া সহস্র সঙ্গী জোগাড় করিয়া আবার যুদ্ধ করিয়াছেন। যুদ্ধ-জয়ের জন্য ভালো সঙ্গী প্রয়োজন।’


পেছনে বসা অসীম উঁকি দিয়ে এক ঝলক দেখে নিয়ে লিখল ‘যুদ্ধে হারিয়া হুমায়ুন জাঙ্গিয়া পড়িলেন না। তিনি পিতা ও গরু বাবরের কথা স্মরণ করিলেন। বাবর কি যুদ্ধে হারিয়া কখনও জাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন? পড়েন নাই। বরং উলঙ্গ হইয়া সহস্র লুঙ্গি জোগাড় করিয়া আবার যুদ্ধ করিয়াছেন। যুদ্ধ-জয়ের জন্য ভালো লুঙ্গি প্রয়োজন।’


অনেক সংবাদপত্র, সাময়িকী, প্রকাশনা সংস্থা, আভিধানিক, বৈয়াকরণ, পণ্ডিত, কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্ব স্ব ভাষারীতি বানিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো বানান লিখে যাচ্ছে। এতে বানান-মহালে আজ বিশ্রী-জট লেগে গেছে। ‘যুবতী’র পিঠে দীর্ঘ-ঈ কারের ঘোমটা এক টানে খুলে তার বুকের উপর হ্রস্ব-ই কারের এক চিলতে ওড়না (যুবতি) চাপিয়ে দেয়ার খাসলত পাল্টানো দরকার। কারণ অপ্রয়োজনে বানানের বিকল্প ভাষায় টেনে আনা সুলক্ষণ নয়। আর বিকল্প নিয়মেও প্রমাণ নয়। শেষে একটি কৌতুক শুনুন:


এক শানদার বিজ্ঞ ব্যক্তি একটা বেড়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে শিষ্যদের বললেন, বাঘের মাসিটাকে কাঁচা মরিচ খাইয়ে দাও। উৎসাহী এক শিষ্য ভয়ে আধমরা বেড়ালটির মুখে কাঁচা লঙ্কা ঠেসে ধরতেই কামড় আর নখের আঁচড় খেয়ে রক্ষাক্ত হলো। আরেক শিষ্য দুধের বাটিতে মরিচ মিশিয়ে দিয়েও বেড়ালটিকে বোকা বানাতে পারেনি। শিষ্যকুল একে একে ব্যর্থতা কবুল করে নিলো।


এবার শানদার বিদ্বান একটি মরিচ বেড়ালের পশ্চাৎদেশে ঘষে দিয়ে বিজয়ীর বেশে থার্টি টু অল-আউট করে (বত্রিশ দাঁত বের করে) হাসছেন।


শিষ্যকুল অবাক হয়ে দেখল, অসহায় মার্জার নিজের পশ্চাৎদেশের মরিচ স্বেচ্ছায় চেটে চেটে খাচ্ছে!


মনে পড়ে গেল, উজবুক পাকিস্তানিরা এক সময় জোর করে উর্দু খাওয়াতে চেয়েছিল। পারেনি। অথচ ‘মহান মিত্র’ ভারতীয়রা আজ আমাদের পশ্চাৎদেশে হিন্দি ডলে দিচ্ছে। জ্বলছে বটে, কিন্তু অসহায় আনন্দে আমাদের নাচতেও হচ্ছে।


লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com