ডেঙ্গু রোগী: মুগদা হাসপাতালে ৪ জনের ১ জনই শিশু!
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৩, ২৩:০৯
ডেঙ্গু রোগী: মুগদা হাসপাতালে ৪ জনের ১ জনই শিশু!
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষত রাজধানী ঢাকায় আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। হাসপাতালগুলোতেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু রোগীর এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।


এদিকে ডেঙ্গু দ্রুত বাড়ার কারণে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ১৩তলা হাসপাতালটির পৃথক চারটি তলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোর শয্যা রোগীতে পূর্ণ থাকায় অনেকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এমনকি লিফট ও সিঁড়িতে ওঠানামা করার জায়গাতেও বিছানা পেতে আছেন অনেকে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালের শয্যায় মশারির ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিলেও চিকিৎসাধীন রোগীদের কাউকেই মশারি টাঙাতে দেখা যায়নি। এছাড়া হাসপাতালের প্রতি চারজন ডেঙ্গু রোগীর একজন শিশু।



হাসপাতালটির পরিচালক বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) বিবার্তাকে জানিয়েছেন, আজ হাসপাতালে ৪৮১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ১২৩ জনই শিশু। একদিনে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ১৫০ জন। আইসিইউতে আটজন ডেঙ্গু রোগী আছেন। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় কারো মৃত্যু হয়নি।


চিকিৎসকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার প্রকোপ বাড়ায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জ্বরসহ যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো ও চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।


বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ১৩তলা বিশিষ্ট হাসপাতালটির ভবন পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করা। ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় সিঁড়ির ও লিফটে ওঠানামা করার জন্য যে খোলা জায়গা রয়েছে সেসব জায়গাগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি করে চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালটির দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, দশম ও এগারো তলায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, দশম তলা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ডেডিকেট করে রাখা হলেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১১ তলার খোলা জায়গায়ও ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালের জনবলে তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাওয়ায় অন্যান্য হাসপাতাল থেকেও সাপোর্টিং নার্স স্টাফ নিয়ে আসা হয়েছে।


এরকমই একজন নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ ব্রাদার ইমাম হাসান। বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে হাসপাতালের ১১ তলায় গিয়ে দেখা যায়, টেবিলে কাগজপত্র ও ওষুধ রাখার জায়গা ঠিক করছেন তিনি। ওইখানে খোলা জায়গায় ২৬ জন রোগীই মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছেন।


জানতে চাইলে ইমাম হাসান বিবার্তাকে বলেন, আমরা ছয়জন আজ সকালে খানপুর হাসপাতাল থেকে এসেছি। এখানকার জনবল ডেঙ্গু রোগীদের কাভার দিতে পারছে না। আমরা ব্যাকআপ দিতে এসেছি। রোগীদের ব্যাপারে বিস্তারিত ১০তলা থেকে বলতে পারবে।


হাসপাতালে আসা ডেঙ্গু রোগীদের সবচেয়ে বেশি চাপ দেখা গেছে দশম তলায়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলে দেখা যায়, সিঁড়ি ও লিফটের গোড়া থেকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। একেকটি শয্যার সামনে-পিছনে অন্তত দুই থেকে তিনটি সারি করে বিছানা পেতে রয়েছেন রোগীরা। রোগীতে ভর্তি পুরো ফ্লোর। হাঁটার জন্য দুই থেকে আড়াই ফুট করে জায়গা ফাঁকা রয়েছে।



ফ্লোরটির পশ্চিমাংশের বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাশেদ হাসান। গত ২ জুলাই নরসিংদীর শিবপুর থেকে চাকুরি সূত্রে জীবনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছেন তিনি। রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজ লাগোয়া ঢাকা ওয়াসা কেন্দ্রের পাম্পে চাকরি করেন। থাকেন সায়েদাবাদ ঢাকা ওয়াসা কোয়ার্টারে।


রাশেদ হাসান বিবার্তাকে বলেন, কাল (বুধবার) বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে হাসপাতাল এসেছি। আসার পর ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। এখানে আসার আগে চারদিন জ্বর ছিল। তবে এখন ভালো আছি। হাসপাতাল থেকে ভালো সাপোর্ট পাচ্ছি। তবে আর কয়দিন থাকতে হবে এখনো বলেনি।


তিনি বলেন, ঢাকায় আসার পরই অসুস্থ। প্রথমে ভেবেছিলাম আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে জ্বর এসেছে। ডেঙ্গু হতে পারে এমন পরামর্শ পেয়ে হাসপাতালে এসেছি। বাড়ি থেকে যখন একবার চলে এসেছি এখন এখানেই (ঢাকা) থাকব। থাকতে হবে।


গত ৯ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন জুরাইন থেকে আসা রিয়াদুল ইসলাম। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ৮ তারিখ রাতে একটু জ্বর হয়েছিল। পরদিন সকালে খাওয়ার পর বমি হয়। সেই বমির সাথে রক্তও আসে। পরে সাথে সাথে হাসপাতালে চলে আসি। এখন প্লাটিলেট ১ লাখ ৫০ হাজারে আছে। হাসপাতাল থেকে ভালো সাপোর্ট পেয়েছি।


ডেঙ্গু জ্বরের সাথে স্বাভাবিক জ্বরের পার্থক্য কি? জানতে চাইলে রিয়াদুল বলেন, জ্বর তো জ্বরই। তবে ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ অনেক উইক (দুর্বল) হয়ে যায়। শরীরে প্রচুর ব্যাথা করে।


বেলা ২টার দিকে কথা হয় দশম তলা চিকিৎসা দেয়া একজন সিনিয়র স্টাফ নার্সের সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবার্তাকে বলেন, এই তলায় ২০২ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এই তলায় রোগীদের চাপ বাড়ায় ওভার হয়ে এখন কিছু রোগী ১১ তলায় গেছে।


সাপোর্টিং স্টাফ আরো বাড়ানো প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, নিয়মিত রোগীর চেয়ে আমাদের জন্য এটা অনেক বেশি বাড়তি চাপ। রোগীরা প্রতিনিয়ত আসছে। আমরাও সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। আরো স্টাফ বাড়ানো গেলে ভালো হত।


এই ফ্লোরে ২০২ জন রোগী থাকলেও কোনো রোগীর শয্যাতেই মশারি টাঙানো ছিল না। এর কারণে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো বারবার পেশেন্টদের বলছি মশারি টাঙানোর জন্য। কিন্তু এই নিয়ম কেউ তো মানতে চাইছে না।


দুইদিন চিকিৎসা নেয়ার পর রিলিজ পেয়েছেন মাদারটেকের ব্যবসায়ী আনিসুল ইসলাম। মশারি না টানিয়ে বসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, অতিরিক্ত রোগী। এমনিতেই গরম, তার উপর ওপর-নিচে ফ্লোরিং করে মানুষ শুয়ে আছে। ফ্যানে তো কিছুই হচ্ছে না। এর মধ্যে মশারি টানালে আরো গরম লাগে। রোগীরা মশারি ছাড়াই আছেন বলে জানান তিনি।


হাসপাতালের ষষ্ট তলায় শিশু বিভাগ। তবে বিভাগের ভেতরে জায়গা না থাকায় এই ফ্লোরেরও ওপেন স্পেসে চলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা। ডেঙ্গু ওয়ার্ডের পেশেন্ট বেডের কাছে বিছানা পেতে তিন বছর বয়সী শিশুকে নিয়ে বসেছিলেন যাত্রবাড়ীর নুপুর। শিশুটির স্যালাইন চলছিল।


নুপুর বিবার্তাকে বলেন, ৪-৫ দিন ধরে জ্বর থাকার পর ভালো হয়ে গিয়েছিল। আবার জ্বর হওয়ায় গতকাল (বুধবার) নিয়ে এসেছি। ডাক্তার দেখে গেছেন। এখন খানিকটা ভালো আছে। ফ্লোরিং বেডে বসে দেখা যায় ফ্যানের বাতাস একদমই গায়ে লাগছে না। তিনি বলেন, গরমে প্রচুর সমস্যা হচ্ছে।


এর তিন শয্যা পরে হাতে ক্যানোলা নিয়ে বসেছিল শান্তিবাগের শারমিন (৪)। পাশে বসা শারমিনের মা নাজনিন বেগম বিবার্তাকে জানান, গত তিনদিন ধরে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন তিনি। কয়েকদিন আগে জ্বর উঠেছিল। আমরা ভেবেছিলাম এমনিতে কমে যাবে। চারদিন হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। পরে দেখা যায় ডেঙ্গু।



তিনি বলেন, ক্যানোলা হাতে লাগানো থাকায় মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। আর ব্যথা হলে উঠে বসে পড়ে। বারবার জানতে চায় বাসায় কবে ফিরবো? না কমলে তো ফিরতে পারছি না। সান্ত্বনা দিয়ে রাখছি।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, আমাদের হাসপাতালটি ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট। এমনিতেই রোগীর চাপ থাকে। এর মধ্যে সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে। নিয়মিত রোগীর চেয়ে এখন দ্বিগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।


জনবল কম থাকা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় প্রভাব ফেলছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালের রেফারেন্সের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল থেকেও ডেঙ্গু রোগী নিয়মিত আসছে। আর যারাই এসেছে সবাই খুবই জটিল অবস্থায় আসছে। আমাদের এটি টারশিয়ারি হাসপাতাল। রোগী আসলে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে চিকিৎসা দেয়া। আপদকালীন সময়ে ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধির ফলে একটু চাপ যাচ্ছে। তবে আমাদের নিজস্ব জনবলের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ডাক্তার, নার্স পদায়ন করা হয়েছে। ওষুধও অ্যাবেইলেবল আছে।


চারজনে একজন শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নিয়াতুজ্জামান বলেন, মনসুন সিজন চলছে। এই পরিবেশ মশা বিস্তারের চমৎকার সময়। প্রতি চারজনে একজন শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুরা বেশিরভাগ সময় ঘরবন্দি থাকে। আমরা বাসায় নিশ্চয়ই শিশুদের মশারিতে রাখি না। ঘরে থাকা মশাই তো তাদের কামড়াচ্ছে। মশা কামড়ালেও তারা বলতে পারছে না। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে।


সব বয়সের মানুষই সচেতন থাকা জরুরি। কারণ এখনকার ডেঙ্গু রোগে প্রচলিত উপসর্গ নেই। জ্বর বা অন্য কোনো উপসর্গ হলেই পরীক্ষা করুন। তাহলে হয়তো বেঁচে যেতে পারেন- বলেন তিনি।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com