তখন আমাদের নিবাস বরগুনার আমতলীতে ; প্রকৌশলী পিতার চাকরির সূত্রে। আকারে ও প্রকারে আমি তখন এতটাই ক্ষুদ্র যে, খণ্ড খণ্ড কতক স্মৃতি ছাড়া আর সবকিছুই বিস্মৃত হয়েছি। তবে মানসপটে যেসব দৃশ্যের আনাগোনা, তার একটি মাছ ধরার। আহা, যেন এক উৎসব!
যে সরকারি বাড়িটাকে নিজেদের ভাবতাম, তার সামনেই একটা পুকুর। ছিল বাঁধানো ঘাট। পুকুরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপ জিজ্ঞেস করলে বিব্রত হবো তবে মনের গহীন থেকে ভেসে ওঠা বাইনারি কোড বলছে, মাঝে মাঝেই সেখান থেকে মাছ ধরা হতো। জাল দিয়ে অনেকে মিলে মাছ ধরতেন। হৈ চৈ পড়ে যেত।
অনেকটা রূপকথার মতো মনে হতে পারে এখন, ওই স্বল্প-গভীর জলের মাছগুলো আমার চেয়েও দীর্ঘ ছিল! তাই যে পাশে মাছগুলো ধরা হতো, আমি থাকতাম তার থেকে দূরে। আর আজকাল বাজারে যেসব ‘বড়' মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো তখন ধরা পড়লে ছেড়ে দেয়া হতো, যথেষ্ট বড় নয় বলে!
এখানেই শেষ নয়, আরো মজার ঘটনা আছে। বাড়ির কাছেই একটা ক্ষেতমতো জায়গায় চিংড়ি মাছ চলে আসত। নদীর বড় বড় চিংড়ি। কীভাবে আসত কে জানে! যতটুকু বুঝতে পারি, নদীর পানির সঙ্গে চলে আসত। এসেই আটকে যেত। পানি নেমে গেলেও চিংড়িকূলের বিদগ্ধ প্রতিনিধিদের ঘরে ফেরা হতো না।
যত মাছের গল্প করছি, এই সকল মৎস্যকূল আমার উদরে জায়গা পেত না। অন্য রসনা তৃপ্ত করে অন্যের কণ্ঠ দিয়ে চালান হতো।
কারণ আমি তখন মাছ খেতাম না! অবাক হবার কিছু নেই, সত্যি খেতাম না। আরো অবাক হবার কিছু নেই, কারণ আমার বাড়ির কেউ মাছ খেতেন না!
এলাকার বড়কর্তা হিসেবে সমস্ত ভোগে পিতৃমহোদয়ের অগ্রাধিকার থাকলেও তা দুর্ভোগের কারণ হতো মাতৃমহোদয়ের৷ তিনি ও তাঁর কর্মসহযোগীরা মিলে সেই মৎস্যসম্প্রদায়কে কেটেকুটে অন্যকে উপঢৌকন পাঠাতেন৷ কিংবা বাড়িতে রান্না হলেও তা হতো অপরের প্রয়োজনে।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, দ্য কাউ লিভস অন গ্রাস৷ আর আমরা? উই লিভড অন কাউ অর চিকেন।
এখন? বাড়ির লোকেরা সেইসব স্মৃতি হাতড়ে যেন মরমে মরে যান। কী ভীষণ আফসোস!
মাছের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে আরেকটু পরে। তা-ও বড় মাছগুলোই খেতে মজা, এই গূঢ় তত্ত্বের ওপর ভর করে। এই তত্ত্বে বিশ্বাস ছিল বহুকাল। যখন বরগুনার পাট চুকিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কুমিল্লায় পাড়ি দিলাম, তখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কত হাঁকিয়ে হেঁকে গেছেন ‘কাচকি কাচকি' করে। আমাদের টলাতে পারেননি।
এমনকি কালের বিবর্তনে টাকি-টেংরারা কখনো-সখনো টেবিল অবধি আসতে পারলেও, আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি; মুখও। আর কৈ মাছও আমাকে টানতে পারলো কই? পেরেছে, আরো পরে।
স্কুল পেরিয়ে কলেজ। সেই সুবাদে রাজধানীকে চেনা। কত লোক, কত রং, কত ব্যস্ততা! মলা-ঢেলাদের সঙ্গে প্রথম ভাব জমিয়েছি এখানেই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় মাছ ভর্তায় মজেছি। বন্ধুদের সঙ্গে চলে গিয়েছি চিরল চিরল বাতাস বয় যেখানে, সেই বিরিশিরি।
ওখানে আলুভর্তা স্পেশালিস্ট এক রাঁধুনি খাওয়ালেন বাঁশপাতা মাছ। আহা কী স্বাদ!
পেশাগত প্রয়োজনে ছুটে বেড়িয়েছি, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। শোল, পিউলি, বাটা, শিং, মাগুর, তপসে, পাবদা, খলসে, কাচকি, পাইশা, সরপুটিরা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। আমিও খেয়েছি তাদের৷
একবার রাজশাহীতে এক অনুজ খাওয়ালেন পদ্মার পাঁচমিশালী মাছ। নাম জানি না, নানা রকমের ছোট মাছের মিশ্রণ। খুব ভোরে ঘাটে পাওয়া যায় মাছগুলো। উঠে আসে অন্য মাছের সঙ্গে। ঝোল করে রান্না হলো। মুখে দিলেই গলে যায়। জিহ্বা থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত স্বাদ টের পাওয়া যায়।
সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বন শহরেও খুঁজে পেয়েছি এক ঠিকানা, যেখানে গেলে মেলে দেশি মাছ। সেসব মাছেরা জল ছেড়ে বরফে ঢেকে এ পর্যন্ত আসতে মাস পেরিয়ে যায়। তাতে কি? দেশি মাছ তো৷
দেশে-বিদেশে কত জায়গায় কত মাছ খেয়েছি, কিন্তু মিঠা পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছের স্বাদ আর কোথায়? নেই। চাষের মাছে আশ কি মেটে?
যুবায়ের আহমেদের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]