শিরোনাম
ই-কমার্স উদ্যোক্তা ড চিং চিংয়ের জীবন সংগ্রাম
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:১৪
ই-কমার্স উদ্যোক্তা ড চিং চিংয়ের জীবন সংগ্রাম
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

''মাস্টার্স পাস করার পর চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখলেই আবেদন করতাম। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় ভালো করলেও মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যেতাম। চেষ্টা করেও যখন সরকারি চাকরি হচ্ছিল না, বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ৩২তম বিসিএস পরীক্ষা দিই। সেখানেও হলো না। তখন নিজে কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম। মাথায় আসে দেশে প্রায় হারিয়ে যাওয়া দুটি ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করার বিষয়টি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাইনি।''


এভাবেই ক্যারিয়ার শুরুর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন ই-কমার্স উদ্যোক্তা ড চিং চিং।


নিউজ পেপার দিয়ে ডোরবেল, গহনা ইত্যাদি তৈরি করে ড চিং চিং ফেসবুকে নিজের আইডিতে শেয়ার করতেন। ফেসবুকে দেখে অনেকেই তাঁকে অর্ডার দেন। সেই থেকে শুরু। অনলাইন শপের মাধ্যমে বিক্রিটা ভালোই হয়। এরপর ফিনারি (finery) নামে একটি অনলাইন পেজ খুলেন। এই অনলাইন শপের মাধ্যমে বিক্রি করেন নিজের তৈরি জিনিসপত্র।


ড চিং চিং-এর জন্ম বান্দরবানের মধ্যমপাড়ায়। তার বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বান্দরবান থেকে ২০০৩ সালে এসএসসি, ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করেন। ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে ইতিহাসে স্নাতক এবং ২০১৪ সালে এমএ করেন।



পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কম্পানিতে খণ্ডকালীন চাকরিও করেন। কিন্তু মেয়ে হওয়ার কারণে তাকে সেখানে বেতন বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। পড়াশোনা শেষে হোস্টেল ছেড়ে দিতে হয়। একা একজন মেয়েকে বাসা ভাড়া দিতে চাইতেন না বাড়িওয়ালা। এ সমস্যা সমাধানে ২০১৩ সালে বিয়ে করেন।


এখন ঘরে বসেই তিনি তার তৈরি জিনিস বাজারজাত করছেন। তার তৈরি জিনিস ২০০ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে স্বামীরও সহযোগিতা রয়েছে।


চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে যখন মিলছিল না তখন মাথায় আসে প্রায় হারিয়ে যাওয়া রিকসা পেইন্ট ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গহনা নিয়ে কাজ করার বিষয়টি। ড চিং চিং বলেন, হস্তশিল্প নিয়ে অনেকেই কাজ করেন। গহনারও অনেক দোকান আছে। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কেউ কাজ করছেন না। যেহেতু রিকসা পেইন্ট দেশীয় ঐতিহ্য আর উপজাতীয় গহনাও বিলুপ্তির পথে, তাই এ দুটি জিনিস নিয়ে কাজ করলে একদিকে যেমন দেশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করা যাবে, অন্যদিকে ব্যবসাও হবে।


পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু না কিছু তৈরি করতে ভালো লাগত তাঁর। নিউজ পেপার, রং, তুলি, আঠা দিয়ে ডোরবেল, গহনা ইত্যাদি তৈরি করতেন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা তাঁর হাতের কাজ দেখে প্রেরণা দিতেন। তাঁদের উৎসাহে ফেসবুকে শেয়ার করতেন। অনেক সাড়া পেতেন। ক্রেতাদের আগ্রহেই অনলাইনে পেজ খুলেন। ২০১৫ সালে এটাকে পেশা হিসেবে নেন।


ডোরবেল আর গহনা তৈরি করেই থেমে থাকেননি ড চিং চিং। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক-আশাক, গহনা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। গহনায় তিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গহনার মূল থিম তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে রূপা ও পিতলের গহনার প্রচলন রয়েছে। সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি গহনায় পিতলের ওপর রূপার এন্টি কালার করেন।



আদিকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা, খুমী ইত্যাদি উপজাতীয়রা গলার হার হিসেবে ‘পয়সার মালা’, রাজবংশীয়রা রূপার মালা পরতেন। সাধারণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যর পিতল দিয়ে তৈরি পয়সার মালা ব্যবহার করতেন। এর মধ্য দিয়ে শ্রেণীভেদের ব্যবধানও ফুটে উঠত।


অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা মেয়েদের সিলভারের হাঁড়ির কানি গলায় পরিয়ে রাখা হতো, যাতে মঙ্গোলিয়ানরা মারমা মেয়েদের দিকে দৃষ্টি না দেয়। মারমা মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য এটা পরানো হতো। মঙ্গোলিয়ানরা এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরও যুগে যুগে এটা গহনায় রূপান্তরিত হয়।


এ প্রসঙ্গে ড চিং চিং বলেন, এটিকে আমি ডিজাইনের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে তুলেছি। হাঁড়ির কানির নিচের অংশে কয়েকটি পয়সা যুক্ত করে নকশায় নান্দনিকতা আনার চেষ্টা করেছি। যেমন মণিপুরী বিয়ের সময় কনেকে মাথায় তাজ পরানো হয়। এর মধ্যে নতুনত্ব আনতে আরও কিছু যোগ করব।


২০১৬ সালের প্রথমদিকে পানির বোতলে রিকসা পেইন্ট দিয়ে শুরু হয় তার প্রতিষ্ঠান ফিনারি’র যাত্রা শুরুতে পুঁজি একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ালেও তার ব্যবসায়িক কৌশল ও ক্রেতাদের আগ্রহের কারণে সেই সমস্যা সফলভাবেই উতরে যান তিনি। নিজের জমানো ও গৃহকর্তার দেয়া সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে এখন তার প্রতি মাসে দুই লাখ টাকার লেনদেন হয়।


ড চিং চিং বলেন, প্রথমে পানির বোতলে রিকসা পেইন্ট দিয়ে অনলাইনে বাজারজাত শুরু করি। বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু একটি পণ্যে না থেকে আরও পণ্য তৈরি করার জন্য ক্রেতাদের থেকে অর্ডার আসতে থাকলো। এক পর্যায়ে বোতল, এলুমিনিয়ামের কেটলি, অফিসের জন্য ফাইল কেবিনেট, শাড়ি, বাসন, মাটির কাপ-পিরিচ, কাচের গ্লাস, ল্যাম্প ইত্যাদিতে বাংলাদেশের ঐতিহ্য রিকশা পেইন্ট করা শুরু করি। এমনকি আর্টিফিশিয়াল লেদারের উপর, চাবির গোছা, কার্ড হোল্ডার, ওয়ালেট, অফিস ক্লিক বক্স, মাউশপেট, টিস্যু বক্স, গ্লাস পোস্টারেও রিকশা পেইন্ট করছি। সামনে শীতে খাদি কাপড় ও শালে এই পেইন্ট নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে।



ড চিং চিং চান দেশীয় বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে। তাই তাঁতের শাড়ি, খাদি কাপড় বা দেশীয় জিনিস নিয়েই কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন দেশীয় কোনো পণ্য নিয়ে কাজ করলে তাতে সফলতা আসবেই।


এরই মধ্যে ঝুলিতে একটা পুরস্কারও জমা হয়েছে এই অদম্য উদোক্তার। ড চিং চিং ২০১৭ সালে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) পক্ষ থেকে পেয়েছেন উদ্যোক্তা সম্মাননা ২০১৭।


ফিনারির দুই বছরের এই যাত্রায় অনেক বাধা-বিপত্তি পার হতে হয়েছে। প্রথমে পুঁজির সমস্যা, পরে ঘর থেকে পুরোপুরি সহযোগিতা পেলেও বাইরে থেকে আসে নানান প্রতিবন্ধকতা। এসব কারণে কিছুদিন ফিনারির যাত্রা থেমে থাকলেও গৃহকর্তার অনুপ্রেরণায় আবারও শুরু করেন ড চিং চিং।


ফিনারির দুই বছরের এই যাত্রার সাথে এখন জড়িয়ে আছে আরও ১৫ থেকে ২০ জনের উপার্জন। দশ জন শিক্ষার্থীর একটি টিম আছে, যারা শুরু থেকে ফিনারির পণ্য নিয়ে কমিশনভিত্তিক কাজ করছেন। আর কয়েকজন বেকার মহিলা আছেন যারা পাইকারী মূল্যে মালামাল নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছেন।


এরই মধ্যে ফিনারি তিনটি জেলায় ডিলারশিপ দিয়েছে। আরও কয়েকটি জেলায় দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ড চিং চিং বলেন, ফিনারি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে চাই। ফিনারির রিকসা পেইন্ট ও উপজাতি গহনা অনেকের হাতে হাতে বিদেশে যাচ্ছে। তবে সরাসরি বাইরে থেকে ব্যবসায়িক অর্ডার না এলেও তা শিগগিরই হবে বলে আশা করছি।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com