শিরোনাম
নারী বাইকারদের নিয়ে বহুদূর যেতে চান আতিকা রোমা
প্রকাশ : ২৭ মে ২০১৮, ১৬:৩৭
নারী বাইকারদের নিয়ে বহুদূর যেতে চান আতিকা রোমা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

রংপুরের মেয়ে আতিকা রোমা। পঞ্চম শ্রেণী থেকেই বাইক চালানো শুরু তাঁর। মাঝে সময়ের বিশাল একটা গ্যাপ। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ২০০৪ সালে কর্মজীবন শুরু করেন। যাতায়াত করতেন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। এক পর্যায়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত তাঁর কাছে অসহনীয় লাগলে সিএনজি অটোরিক্সায় যাতায়াত করতেন। কিন্তু বেতনের সব টাকা চলে যাচ্ছিল সিএনজিওয়ালার পকেটে। সেটা ঠেকাতেই ২০০৯ সালে শুরু করেন ব্যাটারিচালিত মোটরসাইকেলে যাতায়াত।


রোমা চাকরি করেছেন বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়। জ্যামের শহর রাজধানীতে প্রতিদিন অফিসে যেতে-আসতে তাঁকে রাস্তায় নানান ঝুটঝামেলা পোহাতে হতো। এসব ঝামেলা এড়াতে স্কুটি চালানো শুরু করেন তিনি। আর তাতেই দেখেন এতে যেমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় তেমনি সময়ও সাশ্রয় হয়, আবার গণপরিবহনে নারীদের যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুটঝামেলা পোহাতে হয়, তা থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।


অনেকদিন থেকেই ভাবছিলেন নারীদের যাতায়াতের পথ সহজ করতে স্কুটি প্রশিক্ষণ দেবেন। কিন্তু কোনোভাবেই তা করে উঠতে পারছিলেন না। তখন তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় গৃহকর্মী শিশুদের জন্য একটি সহনীয় পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করছিলেন। কিন্তু গত কিছুদিনে একাধিক সংবাদ তাঁর নজরে আসে। যেগুলো ছিল মূলত গণপরিবহনে নারীদের বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা। তখনই তাঁর মাথায় আসে স্বাধীনভাবে চলাচলাফেরা করতে চাওয়া নারীদের স্কুটি চালানো শেখানোর জন্য একটা উদ্যোগ নেয়ার কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। চাকরি ছেড়ে নিজের উদ্যোগে নারীদের জন্য গড়ে তোলেন ‘যাব বহুদূর’ নামে একটি স্কুটি ড্রাইভিং প্রতিষ্ঠান। এই হলেন নারী বাইকার আতিকা রোমা।


গণপরিবহনের ঝামেলা এড়িয়ে জ্যাম ঠেলে নারীরা যাতে নিজস্ব বাহনে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন, সে লক্ষ্যে আত্মপ্রত্যয়ী নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহস ও প্রেরণা যোগাতে কাজ করছেন নারী বাইকার ও উদ্যোক্তা আতিকা রোমা।



বৃহস্পতিবার দুপুরে কারওয়ান বাজারস্থ বিবার্তা কার্যালয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন আতিকা রোমা। গল্পচ্ছলে জানান ড্রাইভিং স্কুল ‘যাব বহুদূর’ ও নারীদের নিয়ে তাঁর প্রগতিশীল ভাবনার কথা।


বাবা আব্দুল বাকী ছিলেন সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম ও মা হালিদা চৌধুরী রীনা ছিলেন রংপুর গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা। বাবা অবসর জীবনে থাকাকালীন মারা যান ২০০০ সালে। মা বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। দু্ই ভাই-বোনের মধ্যে বড় ভাই আব্দুল আলিম একটি বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত। আর আছে বল্টু ভাই নামের রোমার আদরের একটি বিড়াল। এই হলো আতিকা রোমার ব্যক্তিগত জীবন।


রোমা বর্তমানে কাজ করছেন নারীদের স্কুটি চালনার প্রশিক্ষক হিসেবে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে নৃবিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় এসে কাজ শুরু করেন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায়। সর্বশেষ জাপানি দাতা সংস্থা ‘শাপলা নীড়ে’ অ্যাডভোকেসির দায়িত্ব পালন করছিলেন আতিকা রোমা।


রাজধানীতে গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানির খবর আর হয়রানির চিত্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লেড দিয়ে মেয়েদের পোশাক কেটে দেয়ার ভিডিও ভীষণভাবে নাড়া দেয় এই নারী বাইকারকে। ভাবতে থাকেন কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। হঠাৎ মাথায় আসে মেয়েদের স্কুটি প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি, যাতে সময় এবং নিরাপত্তা দুটোই থাকে একজন নারীর হাতের মুঠোয়। গত দশ বছরে নিজের জীবন দিয়ে এটাই শিখেছেন এই নারী বাইকার। আর তাই বিশাল এক স্বপ্ন নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত জীবনকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ‘যাব বহুদূর’ নামের স্কুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু করেন।



এপ্রিল মাসের প্রথমদিন থেকে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মাঝেই প্রায় ১২টি ব্যাচে ৬৩ জন নারীকে স্কুটি চালানোয় প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন তিনি।


রোমা বলেন, প্রথম মাসে এই উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য সফলতায় আমি অনেক বেশি আশাবাদী হয়ে পড়ি। জানি, আমি পারবোই, পারতে আমাকে হবেই।


ফয়সাল বাপ্পা, অভি মুরশিদ ও সাদ সালমান নামে তিনজন পুরুষ বাইকার প্রশিক্ষক ‘যাব বহুদূরে’র বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রোমার সঙ্গে রয়েছেন, যারা মূলত রোমার সহ-বাইকার হিসেবে ঘুরেছেন দেশের আনাচেকানাচে। এই টিমে রোমা দলনেতা এবং প্রধান প্রশিক্ষক।


প্রশিক্ষকরা সাত দিন ব্যবহারিক ক্লাস নেন। প্রজেক্টর ব্যবহার করে থিওরেটিকাল ক্লাস নেয়া হয় একদিন, যেখানে স্কুটি চালানো নিয়ে খাতা-কলমে ধারণা দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে লাইসেন্স পেতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করেন তাঁরা।


‘যাব বহুদূর’ প্রসঙ্গে রোমা বলেন, মেয়েদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার অন্যতম উপায় হলো মেয়েদের জন্য নিরাপদ সড়কপথ। আর এক্ষেত্রে প্রতিটি মেয়ে যদি স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে চলাচল করতে শেখে তাহলেই সার্থক হবে আমার এ প্রয়াস। আমি চাই নারীরা স্বাধীনভাবে ও নিরাপদে নগরীতে চলাফেরা করুক। আমার বিশ্বাস, যাত্রাপথে নারীরা স্বাবলম্বী হলে নারী স্বাধীনতার পথে তাঁরা এগিয়ে যাবে আরো একধাপ। মেয়েদের নিয়ে যেতে চাই বহুদূর।



রোমা তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো এলাকায় স্কুটি চালনার এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রশিক্ষণার্থীদের কেউ শিক্ষার্থী, কেউ চিকিৎসক, কেউ গৃহিণী, আবার কেউ চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী। প্রশিক্ষণ নিতে আসা মেয়েদের প্রায় ৮৫ ভাগই কোনোদিন সাইকেলও চালায়নি। সেসব নারীকে প্রথম হাঁটতে শেখার মতো হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্কুটি চালানো শেখান তিনি। এ কাজে তাঁর ও তাঁর টিমের ধৈর্য সীমাহীন।


‘যাব বহুদূর’কে প্রশিক্ষণের জন্য বিনামূল্যে স্কুটি দিয়েছে টিভিএস অটো বাংলাদেশ। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রোমা। এ কাজের শুরুতে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছেন রোমা। নিরাপদ জায়গা খোঁজা, প্রশিক্ষণার্থীদের নিরাপত্তা দেয়া, প্রশিক্ষণের জন্য জায়গা প্রস্তুত করার কাজ বেশ কঠিন ছিল। তবে এ কাজে পরিবারপরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে পেয়েছেন উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও অসীম ভালবাসা।


রোমা বাংলাদেশের প্রথম নারী বাইক রাইডার, যিনি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে স্কুটি চালিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সড়ক এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সড়ক থানচি আলীকদম যাওয়ার রাস্তায় ডিম পাহাড় সড়ক অতিক্রম করেছেন। তিনি বাইক নিয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১,২৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছেন। স্কুটি চালিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-বান্দরবান-কক্সবাজার-টেকনাফ-কক্সবাজার হয়ে পুনরায় ঢাকা ফিরেছেন। এতে তাঁর সময় লেগেছে তিনদিন।


রোমা শুধু বাইকারই নন, তিনি একজন নামকরা ভলিবল খেলোয়াড়ও। রংপুরে জেলা দলের হয়ে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে পুরস্কারও পেয়েছেন। এছাড়া, রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়ার সময় পরপর তিন বছর ভলিবল টিমের ক্যাপ্টেনের দায়িত্বও পালন করেছেন।



খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক থাকায় শৈশবে রোমা ভাবতেন খেলোয়াড় হবেন। অন্যদিকে বাবা-মা গানের শিল্পী বানানোর জন্য তাঁকে সংগীত একাডেমিতেও পাঠিয়েছিলেন। রোমা যেতেন ঠিকই, কিন্তু গানের ক্লাস তাঁর ভালো লাগতো না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করেই সময় কাটাতেন। এ ব্যাপারে রোমার ভাষ্য, গতিহীন কোনকিছুই তাঁর পছন্দ না। বল বা গাড়ি নিয়ে যত খেলেছেন, পুতুল নিয়ে একদম খেলেননি বললেই চলে।


‘যাব বহুদূর’কে নিয়ে রোমার স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। এখন ছোট পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, কিন্তু সাড়া পাচ্ছেন অনেক। প্রতিদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলাশহর থেকে অসংখ্য নারী ফেসবুকে ও ফোনে স্কুটি চালনা শেখার জন্য তাঁর সাথে যোগাযোগ করছেন। নারীদের আগ্রহ দেখে তিনি এই কার্যক্রমকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান। এ লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ৭ দিন, দুই সেশনে ১৪ দিন করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এছাড়াও সারাদেশের সচেতন ও প্রগতিশীল বাইকারদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক বাইকারকে নিয়ে একটা টিম গড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁর, যারা জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী বাইকারদের নিরাপদ পথচলায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।


‘যাব বহুদূর’ থেকে যেসব নারী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে থেকেও ট্রেইনার তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন রোমা। রোমার ভাষ্যমতে, বাইকিং প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দেশের যুবসমাজকে নতুন ধরনের একটি ক্যারিয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ইচ্ছে তাঁর, যাতে করে দেশের অনেক বেকার যুবক ও তরুণী নতুন একটি কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আনন্দের সাথে আয়-রোজগার করে সমৃদ্ধ হতে পারে।


‘যাব বহুদূরে’ স্কুটি চালানো শিখতে চাইলে একটি ফরম পূরণ করে পাঠিয়ে দিতে হবে। ফর্মটি পেতে ‘যাব বহুদূর’ এর ফেসবুক পেজের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ‘ফর্ম’ লিখে পোস্ট করলেই দেয়া হবে ফর্মের সফট কপি। এরপর ফর্মটি পাঠাতে হবে একটি নির্দিষ্ট ই-মেইল ঠিকানায়। সেখান থেকেই ডাকা হবে প্রশিক্ষণের জন্য। এছাড়া প্রথম ক্লাসের শুরুতে কোর্স ফি হিসেবে তিন হাজার টাকা দিতে হবে। যাঁরা স্কুটি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে চান, তাঁরা ‘যাব বহুদূরে’র ফেসবুক পেজে যুক্ত হয়ে যোগাযোগ করতে পারবেন। আগ্রহীকে যোগাযোগ করতে হবে: https://www.facebook.com/amijabobohudur/ এই ঠিকানায়।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com