ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
তিতাস-মেঘনা নদীপথে যাতায়াতে অতীত সোনালি দিনগুলো
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:১৬
তিতাস-মেঘনা নদীপথে যাতায়াতে অতীত সোনালি দিনগুলো
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস-মেঘনা নদীপথে লঞ্চের প্রয়োজন প্রায় শেষের পথে। অতীত হতে চলেছে লঞ্চের সোনালি দিনগুলো। লঞ্চ টার্মিনাল টোল আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী খায়ের মিয়ার চোখ-মুখেই যেন ভাসছে দুরবস্থার চিত্র। যাত্রী নেই। হঠাৎ ২ -১ জন এলে তাদের সঙ্গে বচসায় লিপ্ত হচ্ছে এই কর্মচারী। টার্মিনালে নেই কোলাহল। ঘাটে বাঁধা একটি, লঞ্চ মাস্টার সুকানিদের মুখও ভার। পাশের নদীও যেন ঘুমন্ত।


সম্প্রতি নবীনগর লঞ্চঘাটে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে একবারও শোনা যায়নি লঞ্চের একটি হর্ন। ঘাট থেকে ভৈরবের পথে একটি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। লঞ্চটি দেখিয়ে টার্মিনালের টোল আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী খায়ের মিয়া লঞ্চটি বলেন, ‘এই লঞ্চটা ভৈরব যাইবো, নিচে ৩ হাজার টাকা খরচ অইবো। লোক মনে-অয় ১০ জনও অইছে না। সংগ্রামের ৪-৫ বছর পর থেকে তিনি লঞ্চ টার্মিনালে রয়েছেন জানিয়ে আরও বলেন, আগে লোক আছিল। তিন লাইনে লঞ্চ চলছে। অহন মানুষ চাইরো বাগুল (চারদিক) দিয়ে যায়গা। মেলাদিন ধইরা এই অবস্থা।’


নবীনগর ছিল লঞ্চের জংশন। এখান থেকেই ভৈরব, নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পথে লঞ্চ চলেছে। ছোট-বড় ৪০-৪৫টি লঞ্চ চলতো এই ৩ রুটে। তিতাস ও মেঘনা নদীবর্তী এই উপজেলায় যাতায়াতের প্রধান বাহনই ছিল লঞ্চ। এখন চলছে ১১টি লঞ্চ। খোঁজ নিয়ে জানা যায় , ২০০৯ সালের শেষে স্পিডবোট চালু হলে কিছুটা ধাক্কা খায় লঞ্চ ব্যবসায়ীরা। এরপর জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন দিক দিয়ে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে, ৩ বছর আগে নবীনগর - ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের লঞ্চ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ নরসিংদী - নবীনগর রুটেও লঞ্চ চলাচল। এখন শুধু ভৈরব-নবীনগর পথেই চলছে লঞ্চ।


এম এল মুন্না নামের লঞ্চের মাস্টার জসিম উদ্দিন জানান, এই রুটও আর বেশি দিন চলতো না। আশুগঞ্জ-নবীনগর সড়ক নির্মাণ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে। এ পথেও আর যাত্রী পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। সড়কটির নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও অটোতে করে এখনই মানুষ চলাচল করছেন। আগে বিকল্প রাস্তা ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট অইয়া গেছেগা। ট্রলার ছিল না, স্পিডবোট ছিল না।


লঞ্চ মাস্টার জসিমের বাড়ি ফেনীতে। ১৭ বছর ধরে একই মালিকের লঞ্চ চালাচ্ছেন। ৩ বছর ধরে এ রুটে লঞ্চ ব্যবসায় মন্দা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভৈরবে আইতে - যাইতে ১৫ লিটার করে ৩০ লিটার তেল লাগে। যার দাম ৩১শ’ টাকা। সঙ্গে ১ লিটার মবিল। এরপর আছে স্টাফদের হাত খরচ। আপ ডাউনে ৩৫ - ৪০ জন যাত্রী হয়। আগে ভৈরব আপ ডাউনে ১২ -১৩ হাজার টাকা কালেকশন হয়েছে। আর এখন দুই টিপে ৫-৬ হাজারও হয় না। আগে মালিকরা রুজি করে পাইতো মাসে লাখখানেক টাকা। এখন ৩০ - ৪০ হাজার টাকাও তুলতে পারি না।


আলভী - জীম লঞ্চ মাস্টার মিজানুর রহমান ৪ বছর ধরে এই রুটে আছেন। এর আগে তিনি মাওয়াতে ছিলেন। পদ্মা ব্রিজ হয়ে যাওয়ার পর চলে আসেন এখানে। মিজানুর রহমানের বাড়ি ফরিদপুর। তিনি বলেন, আমরা তো অন্য কাজ করতে পারি না। যুবক বয়স থেকেই এ কাজ শিখেছি। এছাড়া জাহাজের চাকরি এক ধরণের নেশার মতন। আগে থেকে এইটাই করে আসছি। যারা লঞ্চে-জাহাজে কাজ করে তদের সেদিকেই মন থাকে। দেশ গ্রামে আমাদের কোনো কাজ নেই। কামলা দিবো, এটাও তো পারি না। সমাজ-টমাজ আছে। আগে তো ভালোই ছিল। গত ৩ বছর এক রকম ছিল। এই বছর আরও কম।


রুটঘাট হওয়ায় মানুষ সিএনজি অটোতে যায়গা ভৈরবে। সামনে যেয়ে বাসে উঠে পড়ে। দু’-আড়াই ঘণ্টা বসে কেইবা লঞ্চে যেতে চায় এখন। সময়ের ব্যাপার স্যাপার আছে। মানুষের হাতে টাকা পয়সাও বেশি। স্পিডবোটে যায়গা ৪০ মিনিটে আড়াইশ’ টাকা ভাড়ায়। নবীনগর থেকে ভৈরবের পথে ফাঁড়ি স্টেশনের যাত্রীরাই লঞ্চে ওঠে। এখন আর ডাইরেক্ট ভৈরবের প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায় না। নবীনগর থেকে ভৈরর পথে লালপুর, বাইশমৌজা, গাছতলা, কালিকাপুর, সওদাঘর কান্দি, দুর্গারামপুর- এই ৭টি ঘাটে লঞ্চ যাত্রাবিরতি করে। এসব ঘাট থেকে ৫ - ৭ জন করে যাত্রী ওঠানামা করে।


নবীনগর থেকে লালপুর যাচ্ছিলেন গোলাপী রানী নামে এক লঞ্চ যাত্রী। ২ ঘণ্টা লাগবে তার লঞ্চে যেতে। তিনি বলেন, লঞ্চে এখন মানুষ কম অয়, গাড়ির লাইন অইছে বলে। দুই - চার-পাঁচজন হলে তারা গাড়ি রিজার্ভ নিয়া যায়গা।


রায়পুর - চাঁনপুর ইউনিয়নের সওদাঘর কান্দির ইদ্রিস মিয়া বলেন, তাদের লঞ্চ আর নৌকা ছাড়া যাওয়ার পথ নেই। ব্যবসার দুরবস্থার কারণে মালিকরা লঞ্চ বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টাতে আছেন। এমএল নাফিসা নামে একটি লঞ্চ ৩ বছর ধরে ঘাটে বাঁধা। দরদাম ভালো না হওয়ায় লঞ্চটি বিক্রি হচ্ছে না।


বিবার্তা/আকঞ্জি/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com