
শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়ক ঘেঁষা ঝিনাইগাতী উপজেলার মালিঝিকান্দা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবন থেকে পশ্চিমে প্রায় ৫০০ মিটার কাঁচা রাস্তা পেরোলেই বাঁশঝাড়ের নিচে দেখা মিলবে একটি পাকা স্থাপনা। কেউ দেখিয়ে না দিলে বোঝার উপায় নেই, এই বাঁশঝাড়ের নিচে পাকা স্থাপনা ঘিরে রয়েছে শহীদদের গণকবর ও বধ্যভূমি। কোনো নামফলক না থাকায় স্থানীয়রা ছাড়া নতুন কেউ বুঝতেই পারবে না এই ঐতিহাসিক বধ্যভূমির অস্তিত্ব। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্যাতন ও গণহত্যার সাক্ষী হয়ে অবহেলায়-অযত্নে পড়ে আছে বধ্যভূমি।
সরেজমিন দেখা যায়, স্মৃতিস্তম্ভে শেওলা পড়ে গেছে। অসংখ্য পরগাছা জন্মেছে। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে শুকানো হচ্ছে খড়ি। বেদির ওপর পড়ে আছে গোবর ও খড়। বাঁশঝাড়ের নিচে নাম না-জানা শহীদের স্মরণে এখানে শুধু একটি ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ও এলাকাবাসী জেলার সবচেয়ে বড় এই বধ্যভূমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী জেলার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প স্থাপন করে কয়ারি রোড এলাকায়। এখানে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। ক্যাম্পের পাশেই ছিল টর্চারসেল। যুদ্ধের সময় মানুষের আর্তচিৎকার এখান থেকে ভেসে আসত। ক্যাম্পের ৫০০ মিটার পশ্চিম পাশে ১০ শতাংশ জমিজুড়ে তিন ফুট গভীর গর্ত ছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী অসংখ্য মানুষকে ধরে এই ক্যাম্পে এনে নির্যাতন করে মেরে ফেলত। পরে এই গর্তে মরদেহ ফেলে দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামবাসী এলাকায় ফিরে এসে বড় গর্তটিতে অসংখ্য লাশ দেখতে পান। পরে গ্রামবাসী মিলে গর্তে থাকা লাশগুলো মাটিচাপা দেন। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের শরণার্থী শিবির করা হয়। ভারতে আশ্রয় নেওয়া মানুষ বাড়ি ফেরার পথে এই শিবিরে দুই-তিন দিন বিশ্রাম করতেন। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী ১২ শতাংশ এই বধ্যভূমির জমি অধিগ্রহণ করে একটি ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করে।
স্থানীয় শিক্ষক মো. আলমগীর হোসাইন বলেন, ‘আমরা শুনেছি পাকিস্তানি হানাদাররা টর্চারসেলে মানুষকে নির্যাতন করেছেন। তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে যারা মারা যেতেন, তাদের এখানের গর্তে ফেলে দিতেন। এখানে শত শত মানুষের লাশ পুঁতে রাখা আছে। এটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।’
স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য মো. আকবর আলী বলেন, ‘এই বধ্যভূমির কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। এমনকি দেখাশোনার জন্য কোনো কমিটিও নেই। এটি রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।’
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ্জামান আকন্দ বলেন, ‘এ উপজেলার ঘাগড়া কুনাপাড়া গ্রামের স্মৃতিস্তম্ভ¢টি অযতœ ও অবহেলায় পড়ে আছে। আজ পর্যন্ত এর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় এখানে অবাধে বিচরণ করে গরু-ছাগল। শুকানো হয় গরুর গোবর। এটি জাতির জন্য খুবই লজ্জা ও দুঃখজনক বিষয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করতে হলে এসব বধ্যভূমি (গণকবর) সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘বিষয়টি তিনি জানেন। দ্রæত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বধ্যভূমির সীমানাপ্রাচীরসহ সারা বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া নতুন প্রজন্ম যেন এই বধ্যভূমির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে, সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
বিবার্তা/জাহিদুল/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]