সংঘবদ্ধ অপরাধ বা অর্গানাইজড ক্রাইম এর কথা মনে আসলেই মনে হয়- এর জন্য অবশ্যই একাধিক ব্যক্তি বা কখনো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে এমন একটি সংগঠন বা দল বা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে, যারা প্রচলিত আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে অপরাধ করে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়, যেটাকে কেতাবী ভাষায় অপরাধ বিজ্ঞানীগণ “হোয়াইট কলার ক্রাইম” বলেন। এর বাইরেও অসংখ্য সংঘবদ্ধ অপরাধ বা অর্গানাইজড ক্রাইম হচ্ছে যা প্রচলিত আইনে অপরাধ প্রমাণ ও বিচার করা কঠিন।
আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলব্যাপী এ ধরনের অপরাধের শুরু ও শেষ হয়। আবার একটি নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরেও এর শুরু ও শেষ হতে পারে। যেগুলো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে সেগুলোকে ট্রান্সন্যাশনাল বা আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধ নামে অভিহিত করা হয়।
মানব পাচার, মানব চোরাচালান, মাদক পাচার, অস্ত্রপাচার, মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচার, শেয়ারবাজার কারসাজি (স্টক মার্কেট স্ক্যামিং) ঋণ জালিয়াতি, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন প্রাণী,পশু-পাখি বা তার অংশ বিশেষ সাধারণভাবে আলোচনায় এসেছে। মোবাইল ব্যাংকিং-এর প্লাটফর্ম ব্যবহার করে যে সকল অপরাধ হচ্ছে সেগুলো তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে একাধিক ব্যক্তি এর সাথে জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ এটিও একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ।
ইন্টারনেট-এর প্রচলন ও সাইবার স্পেসে মানবজাতির বিচরণ শুরুর সাথে সাথে সাইবার জগতেও বিভিন্ন অপরাধসহ সংঘবদ্ধ অপরাধটির বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং থেকে ই-ভ্যালির মতো ব্যাবসা, ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যক্তিগত আইডি হ্যাক ও অর্থ আদায়সহ অনলাইন জুয়া বা বেটিং, গেমিং স্ক্যামিং এ ঘরনার অপরাধের মধ্যে পড়ে। এছাড়াও “নাইজেরিয়ান স্ক্যামিং” নামে আমাদের দেশে এক ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ হচ্ছে । মূলত ফেসবুকে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশি নারী (পুরুষ ভিকটিমের ক্ষেত্রে) বা পুরুষ (মেয়ে ভিকটিমের ক্ষেত্রে) বেশে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তার জন্য বিদেশি উপহার বা ডিপ্লম্যাটিক ব্যাগ পাঠিয়ে নাইজেরিয়ানসহ এ দেশের কিছু লোক এ ধরনের অপরাধ করছে যা ইতোমধ্যে বেশ আলোাচিত হলেও সাধারণের মধ্যে তেমন সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাইবার সংঘবদ্ধ অপরাধ নিবারণ নিয়ে বেশ গলদঘর্ম অবস্থায় আছে। আইন তৈরি ও তা বাস্তবায়ন, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদন, সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করণসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার।
মোবাইল ব্যাংকিং ও স্ক্যামিং-এর মাধ্যমে কৃত অপরাধের অর্থ, কিছু কিছু আইডি হ্যাকিং এর অর্থ এবং নাইজেরিয়ান স্ক্যামিং এর অতি সামান্য অর্থ দেশে থাকলেও সাইবার ও ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ অপরাধের অর্থ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাংকিং এর আর্থিক মূল্য জানা গেলেও অনলাইন জুয়া বা বেটিং সাইট ও গেমিং স্ক্যামিং এর মাধ্যমে কৃত অপরাধের আর্থিক মূল্য ঠিক কত তা এখনো কোনো সংস্থা বের করতে পারেনি। বছরে ২০০ কোটি বা এর কাছাকাছি বলা হলেও আসলে তা কত জানা যাচ্ছে না। সবচেয়ে দুঃখজনক যে এই অর্থ সম্পূর্ণ ডলারে রূপান্তর করে অপরাধীরা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে যা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভকে সরাসরি প্রভাবিত করছে বা এই অপরাধের অর্থ আর অন্য কোনোভাবে পরিশোধ হচ্ছে কি না (ডাইরেক্ট পার্সেসিং বা আমদানী মূল্য পরিশোধ) তাও নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে না। কোনো সংস্থা এ গবেষণাটি করতে পারে।
অনলাইন জুয়া বা বেটিং এর সাইটগুলো যখন দেশের সেলিব্রেটিরা প্রোমট করে বা বিজ্ঞাপনের মডেল হয় তখন আমাদের মতো সাধারণ ও লোভী নাগরিকদের মধ্যে এক ধরণের আগ্রহ জন্মাবে এটাই স্বাভাবিক। কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে এ বিষয়ে আলাপ হওয়ার পর আমার মনে হয়েছে এটি নিমিষেই বড়লোক হওয়ার লোভের সাথে সাথে মাদকের মতো আসক্তির মতো কাজ করে। জুয়াড়িরা দেশের অভ্যন্তরে টাকার জন্য খুনসহ নানাবিধ অপরাধের সাথে, বিশেষ করে সম্পত্তির বিরুদ্ধে অপরাধে খুব দ্রুত যুক্ত হচ্ছে যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিটিআরসি নিয়মিত সাইবার পেট্রোলিং-এর মাধ্যমে বছরে অসংখ্য সাইবার বা অনলাইন বেটিং বা জুয়ার সাইট বন্ধ করলেও এর বিস্তার কমানো যাচ্ছে না। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চলতি বছর ৩৩১ টি সাইট বন্ধ করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া গুগল থেকে ১৫০ টির মতো অ্যাপস বন্ধ করার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও প্রচার ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত ৩৪ টি লিংক ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এরপরও এই সাইবার সংঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি দেশের একজন নামকরা অভিনেত্রী ও মডেলের আত্মহত্যার জন্যও অনলাইন জুয়াকে দোষারোপ করা হচ্ছে।
এ সকল অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এর ২৩ ধারায় শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডি হ্যাক ও তা দ্বারা আর্থিক লাভবান হওয়ার অপরাধ তদন্ত করা সম্ভব। এছাড়া ৩২ ধারায় হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হলেও এই ধারা দিয়ে আইডি হ্যাকিং বা জুয়ার অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না। পুলিশ সাধারণত পেনাল কোডের ৪২০ ধারায় এ ধরণের অর্থাৎ অনলাইন জুয়া বা বেটিং এর মামলাগুলো তদন্ত করছে। এখানেও নতুন করে ভাববার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
তাহলে এখন উপায় কী?
নাগরিকদের সচেতন হতে হবে, বিশেষ করে আমাদের নিমিষেই বড়লোক হওয়ার লোভ সংবরণ করতে হবে।
আসুন নিমিষেই বড়লোক হওয়ার লোভকে হত্যা করি। কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকি।
লেখক : আবদুর রহমান, পুলিশ সুপার।
বিবার্তা/এসবি/লিমন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]