থেতলানো মুখ, কোটরে গলে যাওয়া চোখ, ঘিলু বেরিয়ে আসা মাথা আর রক্তাক্ত তোবড়ানো অচেতন অবস্থায়— রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ছোড়া ইট-পাটকেল, মাঝে পড়ে আছে নিথর দেহ। তারপরও কতিপয় অসুস্থ-বিকৃত অমানুষ তাকে বাঁশ-ইট-হেলমেট-ধারালো কিছু দিয়ে নির্মমতম আঘাত করছে!
২৮ অক্টোবর, শনিবার বিকেল ৪টার দিকে মো. আমিরুল ইসলাম পারভেজ নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডাক্তার যদি দেখত ফকিরাপুলের রাস্তায় তাকে কীভাবে মারা হয়েছে— তাহলে হয়তো তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন মনে করতেন না!
ফকিরাপুল চৌরাস্তার মোড়ে যখন পুলিশের উপর হামলা হয় তখন পারভেজসহ ৪ পুলিশ সদস্য একটি ভবনে ঢুকে পড়েন। সেখান থেকে হঠাৎ কনস্টেবল পারভেজ বাইরে বেরিয়ে আসে। তখনই তার উপর হামলা চালায় বিএনপির সমাবেশ আসা একদল নেতাকর্মী। 'মার শালাগোর! মার কুত্তার বাচ্চাগোর!' আর সম্ভবত উপরের বাসা থেকে যারা ভিডিও করছিল তাদের মধ্য থেকে কোনো একজন নারী দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। আর বলছিলেন— 'পুলিশ। আহারে আহারে একজন গেছে! আল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। একজন শেষ, একজন শেষ।' আর ওইদিকে ২৫/৩০টা বুনো শুয়োর (মানুষ রূপে) আজন্ম বুভুক্ষু হায়েনার মতো পুলিশের উপর পাশবিক আক্রমণ চালাতে থাকে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় ওই পুলিশ সদস্যের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও মানুষের মতো দেখতে জানোয়ারগুলো তার মাথায়, মুখে, শরীরে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। অথচ ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধ থাকলে উচিত ছিল ওই পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
‘বাবা বলছিল আমার সোনা মনিকে খাওয়াইও আর দেইখ্যা রাইখো। আমার বাবা কবরে চলে গেছে, অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার। এখন আমাকে কেউ সোনাপাখি বলে ডাকবে না।’ কান্নাজড়ানো কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল নিহত কনস্টেবল পারভেজের সাত বছর বয়সী মেয়ে তানহা আক্তার। ছোট বলে মেয়েটা জানেই না এই অনটনের সংসারে অনাগত দিনে তার জীবনে কতশত বেদনার পাহাড় অপেক্ষা করছে। আপাতত সেই পাহাড় ডিঙাতে কয়েকঘণ্টা আগে পর্যন্ত যেই মানুষটা বর্তমান ছিল— তিনি এখন শুধুই ছবি, গণমাধ্যমের টিআরপি বাড়ানো রক্তাক্ত উপাখ্যান। কে এমন সাহসী, মেয়েটাকে বলবে— কান্নাই তার ভবিতব্য।
এই যে মানবিক মূল্যবোধবর্জিত অসুস্থ-অস্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মীরা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় একজন পুলিশ কনস্টেবলকে পৈশাচিকভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে কী ম্যাসেজ পৌঁছে দিল? এরা বাংলাদেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে চায়! এরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের নামে গাড়িতে আগুন দিল, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালাল, মানুষ হত্যা করল— মানুষ হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করল!
বাংলাদেশে অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা, রাজনৈতিক সহিংসতা, তুলনামূলক সংখ্যাগরিষ্ঠ অগ্রহণযোগ্য অসৎ মানুষের সম্পৃক্ততার কারণে দিনকে দিন সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ২৮ তারিখে সরকার পতনের সমাবেশ ও শান্তি সমাবেশে আগত লোকজন কোনো কারণে একপক্ষ আরেকপক্ষের সাথে মোকাবিলা হওয়ার সুযোগ পেলে পল্টন, বিজয়নগর, মতিঝিল, বায়তুল মোকাররমে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মুষ্টিমেয় মানুষ সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত। তারও মুষ্টিমেয় অংশ ওইদিন অত্র অঞ্চলে জমায়েত করেছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশের নামে। ওই কিছুসংখ্যক মানুষ যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে— তারা আমজনতাকে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এদের মধ্যে কেউ আছে তাদের কর্মী, সমর্থক অথবা নির্বাচন এলে তারা ওই মার্কায় ভোট দেয়। দিনশেষে এরা সবাই নেতার কাছে— জাস্ট সংখ্যা। অথচ এরাই ক্ষমতা যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
বিস্ময়ের বিষয় হলো পল্টন, বিজয়নগর, মতিঝিল, বায়তুল মোকাররমে জড়ো হওয়া রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং তাদের নানা অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ড সারাদিন সকল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লিড হয়ে থাকল।
অথচ ২৮ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল (কর্ণফুলী টানেল)-এর শুভ উদ্বোধন হয়। টানেলটি উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই টানেলটি বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। চট্টগ্রাম শহরে নিরবিচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা এবং 'আধুনিকায়ন' করতে এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই টানেলের কল্যাণে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৫০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব কমবে। বঙ্গবন্ধু টানেল কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে মেলানোসহ ওই এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের যোগাযোগ ও অর্থনীতিতে এই টানেল মাইলফলক হয়ে থাকবে। তাই এই টানেলের উদ্বোধন ওই এলাকার মানুষের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আর ২৯ অক্টোবর, রবিবার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন। সমাবর্তনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ (মরণোত্তর) ডিগ্রি প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও উন্নত বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
এই আয়োজন নানা কারণে বাংলাদেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের যৌক্তিক আন্দোলনে পক্ষাবলম্বন করায় বহিষ্কার করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সমাবর্তন ছিল। ওই সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুকে ‘সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি দেওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সবচেয়ে ঘৃণ্য বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটে সেইদিন। ঘাতকের দল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নৃশংসভাবে হত্যা করে।
উপরোল্লিখিত দুইটি আয়োজনের সাথেই জনস্বার্থ গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি— শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমগুলোর অপেশাদারিত্ব ও সস্তা পাঠক-শ্রোতা টানার মানসিকতা ও দেশবিরোধী রাজনৈতিক আদর্শের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে!
তাই রাজনীতি সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক মাত্রই উচিত, অল্পসংখ্যক রাজনীতিবিদ যারা ব্রিটিশ-বেনিয়াদের মতো নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকারকে মূল্যায়ন করে না এবং মসনদে টিকে থাকা অথবা আসীন হওয়ার মোহে হরতাল, অবরোধ, জনসভার নামে মানুষ হত্যা করে, নানাভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট করে, মানুষকে মানবিক বোধবুদ্ধিহীন বানায়— তাদের জিম্মিদশা থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে মুক্ত করে একটি মানবিক রাষ্ট্র বির্নিমাণে সকল দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে হবে। তার সাথে সকল অপরাধ এবং বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে।
লেখক: সাহিত্যক ও সাংবাদিক
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]