রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ঢোপকল প্রায় বিলুপ্তির পথে
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ২১:১৬
রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ঢোপকল প্রায় বিলুপ্তির পথে
মোস্তাফিজুর রহমান রানা
প্রিন্ট অ-অ+

প্রতিটি শহরের একটি ইতিহাস থাকে। এমন ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়েই শহরের নাগরিকদের থাকে গর্ব। রাজশাহীও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজশাহীর আছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। আশেপাশে এখনো দেখা যায় সেই সব ঐতিহ্যের কিছু নিদর্শন। রাজশাহীর ঐতিহাসিক নিদর্শনের একটি হলো ঢোপকল। ঢোপকল রাজশাহীর অনেক পুরাতন ঐতিহ্য এবং এর সাথে রাজশাহীর ইতিহাস ও সৌন্দর্য জড়িত।


মহারানী হেমন্ত কুমারীর অনুদানে ১৯৩৭ সালে রাজশাহীতে ঢোপকল স্থাপিত হয়। এই কল স্থাপনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। এই প্রকল্প মহারানী হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস রাজশাহীর‌ ঐতিহ্যবাহী ঢোপকল। এই ঢোপকল তৈরির সময় তৎকালীন রাজশাহীর দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রাইটিন‌ দাশগুপ্ত।


সেই সময় রাজশাহীতে বিশুদ্ধ ও পানযোগ্য পানির খুবই অভাব ছিল। তার ফলে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা ,আমাশয়সহ বিভিন্ন ধরনের পেটের পীড়া। সেই সময় এই অসুখে বেশ কিছু লোকের মৃত্যুও ঘটেছিল।


রাইটিন দাশগুপ্ত তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানযোগ্য পানির সরবরাহের দায়িত্ব নেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির জন্য ঢোপকল বসানো হবে।


১৯৩৭ সালের আগস্ট মাসের কোন এক দিনে মিনিস্ট্রি অফ ক্যালকাটার অধীনে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকারও বেশি। এবং নামকরা ধনী লোকদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্রেই মহারানী হেমন্তকুমারী দান করেন প্রায় ৬৫০০০ টাকা। বিশাল অংকের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ড হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপন করা হয়। কালক্রমে তা হেমন্ত কুমারী ঢোপকল নামে পরিচিত হতে থাকে। পুরো শহর জুড়ে প্রায় শতাধিক ঢোপকল স্থাপন করা হয়।


মহারানী হেমন্ত কুমারী পানি শোধন কেন্দ্রে পানিকে বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করে পানি বিশুদ্ধ করে তা সরবরাহ করা হতো সেই ঢোপগুলোতে। তবে সর্বপ্রথম পাথরকুচির ফিলটার দিয়ে পানি ফিলটার করা হতো। এরপর সিমেন্টের তৈরি মোটা পাইপে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। প্রতিটির পানি ধারণ ক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন। প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল একটি রাফিং ফিলটার।


এতে বালি ও পাথরের স্তর থাকায় সরবরাহ করা পানি আরো পরিশোধিত হয়ে বের হতো। এবং গরমের সময় মোটামুটি তা ঠান্ডাও থাকতো। সারাদিনে মাত্র দুই ঘন্টা পানি সরবরাহ করা হতো। মোড়ে মোড়ে ঢোপকলগুলিতে পানি ধরে রাখা হতো। ফলে সারাদিনই পানি পাওয়া যেত।


দুই মাস পরপর এই ঢোপকলগুলো পরিষ্কার করা হতো। পরিষ্কার করার নিয়মটি ছিল খুবই ভালো। এই ঢোপকলের উপরের ঢাকনা খোলা যেত। ভিতরে মানুষ নেমে ব্লিচিং পাউডার ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে পরিষ্কার করতো।


প্রতি দুই মাস পরপর ঢোপকল থেকে পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করা হতো। সেটা পাঠানো হতো পরীক্ষাগারে- পানির মান ঠিক আছে কিনা তা জানতে।


ঢোপকলগুলো লম্বা প্রায় ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু আর ব্যাস ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো তৈরি করা হয়েছিল সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে। ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো সিমেন্টের প্লাস্টার করা হতো। নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর খোয়া ঢালা হতো। এ ঢালাই খুবই শক্ত- সহজে কোন কিছুর ধাক্কায় ভাঙে না। তবে এই ঢোপকলগুলোর অধিকাংশই প্রায় বিলুপ্ত।


মহানগরীর বেলদারপাড়া ও ফায়ার ব্রিগেডসহ কয়েকটি এলাকার ঢোপকল থেকে এখনো পানি সরবরাহ করা হয়। তবে ঢোপকলের জন্য পানির সরবরাহের যে ব্যবস্থা ছিল এখন আর তা নেই। ঢোপকলে পানি সংগ্রহ করা হয় এখন উপকণ্ঠে স্থাপিত পানি শোধনাগার থেকে।


রাজশাহীর ঐতিহ্য হিসেবে কিছু ঢোপকল চালু রাখা যেতে পারে মোড়ে মোড়ে যা রাজশাহীর ঐতিহ্যের সাক্ষী দিবে।


লেখক: সাংবাদিক


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com