প্রতিকূলতাজয়ী প্রত্যয়ী গবেষক প্রিয়াংকা নাথ
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩:৫৩
প্রতিকূলতাজয়ী প্রত্যয়ী গবেষক প্রিয়াংকা নাথ
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

জয়-পরাজয় এবং উত্থান-পতনের সমুদ্রসম জীবনে প্রতিকূলতাকে জয় করে বিজয়মাল্যে ভূষিত হন যারা, সেই বিজয়ীদের মধ্যেও অনন্য ও অবিস্মরণীয় তারাই যারা স্বপ্নজয়ের সংগ্রামে সহাস্যে বরণ করেন প্রতিকূল প্রতিটি ধাপ। স্বপ্নজয়ের দুর্গম পথে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রতিকূলতাকে সহাস্যে বরণ করে নেওয়া বিজয়ী এবং প্রত্যয়ী এক তরুণীর গল্প বলবো আজ।


নাম তার প্রিয়াংকা নাথ। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রভাষক ও গবেষক। গবেষণাকর্মে নিজেকে জড়িয়েছেন বেশ অনেক বছর ধরেই। গবেষণায় তার আগ্রহের বিষয় ক্যান্সার। ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করার আগে কাজ করেছেন পাবলিক হেলথ নিয়ে। রিসার্চ অফিসার হিসেবে ছিলেন আইসিডিডিআরবিতে। তবে, জীবনের শুরুতেই ব্রত জেনেছিলেন ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করাকে।


কিন্তু অবিশ্বাস্য এই যে, জীবনের একদম শুরুতেই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন আজকের গল্পের প্রিয়াংকা, যার পড়ালেখাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। স্বজনদের আগ্রহের ঝোঁক ছিল বিয়ের দিকে, তথাকথিত সেই চিন্তার সামনে জীবন বিপন্ন হয়েছিল তার যে মেয়েদের ক্ষেত্রে 'বিয়েই জীবনের একমাত্র সমাধান'। কিন্তু প্রিয়াংকা হেরে যাওয়া তো দূরের কথা, টলে যাওয়ার পাত্রটি নন। তার কাছে জীবনের সমাধান এটাই যে সামনে একটি পদক্ষেপ নিয়েই দেখি। সাফল্য নাই আসুক, কিছু একটা তো হবে। আর তাই জীবনের চলার পথে আলাদা করে কখনো অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয়নি। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন স্বপ্নকে সফল করার উদ্দেশ্যেই।


ক্যান্সার বিষয়ে কাজ করার আগ্রহ কবে থেকে এবং কেন প্রশ্নের জবাবে প্রিয়াংকা বলেন, ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার কাজ করছি এখন। কিছুদিন আগে আমার একটি পেপার পাবলিকেশন বের হয়েছে। আমি ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে কাজ করি। ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটা নির্দিষ্ট প্রোটিনের এক্সপ্রেশন নিয়ে কাজ করেছি। এই ক্যান্সার বিষয়ে কাজ করার আগ্রহ আমার অনেক আগে থেকে। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখনকার কথা, হঠাৎ ভাবতে থাকি যে ভবিষ্যতে আমি কী করতে চাই। লিস্টের প্রথমেই ছিল পাইলট হওয়ার স্বপ্ন। আর দ্বিতীয় ইচ্ছাটা ছিল বায়োলজি, মূলত রোগ নিয়ে কাজ করা আর বিশেষত ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা। তবে, ক্যান্সার নিয়ে যে উচ্চতর গবেষণার স্বপ্ন আমি দেখি সেটা সেই সময়, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই, তখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এত সহজ ছিল না। কোন সাবজেক্টে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে আমি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো সেটা আমাকে ভাবতে হয়েছে। আর সেই ভাবনা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা।


শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রসঙ্গে প্রিয়াংকা বলেন, ক্যান্সার নিয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পড়াশোনা করা যাবে তা নিয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিকস নামে একটা সাবজেক্ট আছে। এখানে যেহেতু ক্যান্সার রিলেটেড বিষয় নিয়ে পড়াশোনা হয় তাই আমি ভাবলাম এখানে পড়াশোনা করলে আমার জন্য ভালো হয়। বাংলাদেশে ক্যান্সার নিয়ে যে হাই লেভেলের রিসার্চ এখন হচ্ছে তা কিন্তু ঐ সময়ে এতটা ছিল না কিন্তু যেহেতু আমার প্যাশন ছিল তাই আমি চেষ্টা করলাম। একটা পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম যে ক্যান্সার নিয়ে কাজ করতে হলে আসলে বাংলাদেশের পড়াশোনা যথেষ্ট না, আমাকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে।


নোয়াখালীর মেয়ে প্রিয়াংকা জানান, আমার বাবা আমাদের সাথে ছিল না, মামাই আমার পড়াশোনার খরচ চালাতেন। আমার শাহজালালে পড়াধোনার সব খরচ মামাই চালিয়েছেন। আমার আর্থিক অবস্থা অতটা স্ট্যাবল না থাকায় আমি বুঝতে পারলাম আমার আসলে স্কলারশিপ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বিদেশে পড়ার সুযোগ হবে না। পরে ২০১৬ সালে আমি একটা চাকরি করি, আমার একটা ইকোনোমিক স্ট্যাবলিটি আসে এবং আমি তখন ভাবলাম নিজের প্যাশনের দিকে আগানো যাক। এরপর আমি কমনওয়েলথ স্কলারশিপে আবেদন করি। আমাকে এটার জন্য অনেক কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কেন করতে চাই, কী করবো, দেশে এসে কী করতে চাই ইত্যাদি। তখন আমার যত জমা কথা ছিল ক্যান্সার নিয়ে কাজ করার, পুরোটাই আমি লিখে দিয়েছি। ৩০ মাস পরে আমার স্কলারশিপের আবেদন এজেন্সির কাছে ফরওয়ার্ড হয়। তারপর এক মাস পরে নোটিশ এলো ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম থেকে আমাকে শেয়ারড স্কলারশিপের জন্য সিলেক্ট করেছে। তারা আমাকে বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিলে যোগাগ করতে বলে। যোগাযোগ করার পর ওরাই হচ্ছে সবকিছু প্রসেস করে নেয়।


দেশের বাইরে যাওয়ার প্রতিকূলতা কীভাবে সামলেছেন এই প্রশ্নের জবাবে প্রিয়াংকা বলেন, আমি যেমন স্টুডেন্ট ছিলাম সে তুলনায় আমার ইন্টারের রেজাল্ট একটু খারাপ আসায় নানা দিক থেকে বিয়ের চাপ আসা শুরু হয়। কিন্তু মামা বলেছিলেম যদি পাবলিকে চান্স হয় তাহলে একটু দেখতে পারি। আর নিজের প্যাশনের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না তবে আমাকে নিজের এক্সিস্টেন্স ও মেইন্টেইন করতে হচ্ছিল। আমি তো কোনো ভাবেই বিয়ে করতে পারবো না। আমি দিনের পর দিন শুধু পড়ে গেছি। আর আমার টার্গেট ছিল ঢাকায় থাকবো না। আমি শাহজালালে চান্স পাওয়ার পর সবাই তাদের জবাব পেয়ে গেছে। আমি আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট শেষ করার পর আমার জব হয়ে যায় বারডেমে।


প্রিয়াংকা নাথ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন ২০১৯ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের পাশাপাশি, কুইজ, পরীক্ষা, প্রজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীর কর্মক্ষমতা মূল্যায়নসহ থিসিস প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে আন্ডারগ্র্যাড থিসিস শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নের কাজ করেন প্রিয়াংকা। সেইসাথে গবেষণার কাজও চালাচ্ছেন তিনি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের ফ্যাকাল্টি অ্যাডভাইজার হিসেবেও কাজ করেছেন।


প্রিয়াংকা বলেন, আমি হেমাটোলজি এবং ক্যান্সার বায়োলজি ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছি। আমি পাঁচটি গবেষণা প্রকল্পের সাথে কাজ করেছি যার বেশিরভাগই ছিল পুষ্টি কেন্দ্রিক এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক RCT ট্রায়াল। বারডেমের পর তিনি যুক্ত হন আইসিডিডিআরবিতে। তারপর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাইরে চলে যান। এরপর প্রিয়াংকা নাথ ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহাম থেকে অনকোলজি এবং ক্যান্সার বায়োলজি বিষয়ে মাস্টার অফ সায়েন্স সম্পন্ন করেছেন। তিনি একজন USAID_NGPHEP স্কলার হিসেবে এমপিএইচ সম্পন্ন করেছেন।


পারিবারিক এবং আর্থিক সংকট প্রিয়াংকাকে বারবারই প্রতিকূলতার সামনে দাঁড় করালেও কখনো থেমে যাননি তিনি। অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন সে প্রসঙ্গে প্রিয়াংকা বলেন, আমার সামনে কোন কাজ এলে আমি মনে করি, ও এটা, ঠিক আছে, করে ফেলবো। আমি যদি চেষ্টা করি কিছু একটা তো হবে। আর যদি চেষ্টা না করি, তাহলে কিছুই হবে না। চেষ্টা করলে, তাও ফিফটি ফিফটি চান্স থাকে। সেই সুযোগটা আমি কেন ছাড়বো?


জন্মেছিলেন নোয়াখালীতেই, গ্রাম্য দাইয়ের হাতে। বলা যায় বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই গাঁয়ে জন্ম তার, পৃথিবীর আলো দেখে প্রথমেই বাংলার মাটির স্পর্শ পাওয়া। তাই যেন বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে প্রতিটি স্বপ্নে, লক্ষ্যে দেশকেই ছুঁয়ে থাকে প্রিয়াংকার চেতনা। স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশে খুব উচ্চমানের একটি ক্যান্সার গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলার। এমন একটি ক্যান্সার গবেষণাগার গড়ে তোলা যেখানে তরুণ প্রজন্ম খুব সহজেই কান্সারের গবেষণায় নিযুক্ত হতে পারে। যেন তার নিজের পেরিয়ে আসা প্রতিকূলতার মুখে না পড়তে হয়, অন্য আরেকটিও বাংলাদেশি প্রত্যয়ী তরুণকে।


বিবার্তা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com