সৌন্দর্য ও বাহারি রঙে মুগ্ধকর অপরাজিতা শুধু শোভাবর্ধনে বাগানে ফোটে তেমন নয়, ফুলটি পুজোর ডালায় শোভা পায় সুখ-সমৃদ্ধির প্রত্যাশায়। বাংলার মেয়ে অপরাজিতা সংগীতা, চিন্তা-চেতনায় ব্যতিক্রমী মননের অধিকারী, কর্মগুণে অতুলনীয় অদ্বিতীয়া, সাফল্যে নবকুঁড়িটির চেয়েও স্নিগ্ধ ও সুন্দর। ভালোবাসেন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে, দাঁড় বেয়ে সুন্দরের নৌকা নিয়ে পৌঁছাতে চান এক মানবিক পৃথিবীতে। হাসতে জানেন মানুষ সুখে, কাঁদতে জানেন মানুষের দুঃখে, বলতে জানেন দুঃসহ পৃথিবী কোণে কেঁদে চলা নারীর চোখের জলের কথা, যে শিশুটি বিশ্বের প্রাণ তার জন্যও প্রাণসঞ্চারী হতে সদা প্রস্তুত অপরাজিতা সংগীতা।
সাহিত্যের ভাষায় আর নয়, এবার জানবো অপরাজিতা সংগীতার কাজের কথা। অপরাজিতা সংগীতা। বর্তমানে বাংলাদেশের একজন সফল নারী পরিচালক। জন্মেছিলেন নড়াইলে, ১৬ ডিসেম্বরে। বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে জন্মে প্রতিটি দিন তিনি হয়ে উঠেছেন এক অপরাজিত শক্তি ও সৌন্দর্য। শৈশব কেটেছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, লেখাপড়া-গান-নাচ সবকিছুর হাতেখড়ি হয়েছিল একসাথে। মূলত বাবার কাছেই তার হাতেখড়ি। বাবা গান লিখে সুর করে দিতেন আর তিনি গাইতেন।
সংস্কৃতি অনুরাগী হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে সংগীতা বলেন, ছোটোবেলায় নাচ, গান, লেখাপড়া তিনটিরই একসাথে হাতেখড়ি হয়েছিল আমার। যদিও বড়ো হওয়ার সাথে সাথে পড়ালেখা চাপ বাড়লে অন্যান্য অ্যাক্টিভিটিস কমতে থাকে, তবু খুব দারুণ শৈশব কেটেছে আমার। একইসাথে কবিতা আবৃত্তি করেছি, ছবি আঁকা, নাচ গান করেছি, বিতর্ক-বক্তৃতা সবই করেছি ছোটোবেলা থেকে। এই চর্চার মধ্যে দারুণভাবে বেড়ে ওঠার কৃতিত্ব কাকে দিবেন জানতে চাইলে সংগীতা বলেন, কৃতিত্ব অবশ্যই আমার পরিবারের। যদি আরেকটু স্পেসিফিক করে বলি, কৃতিত্ব আমার বাবার। অবশ্যই মায়ের প্রচেষ্টা ছিল। তবে বাবা খুবই সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তাছাড়া বাবা সবসময় বলতেন আমার মেয়ে যেখানে যাবে সেখানে তার জন্য একটা চেয়ার রাখা থাকবে, আমার মেয়েকে আমি সেভাবে বড়ো করতে চাই। গ্রামে বড়ো হলেও আমি সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক একটা পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। আমার পরিবেশটাই ছিল আমার অনুপ্রেরণা, আমি জানতাম এটাই আমার লক্ষ্য।
শৈশব জাল বুনে যখন কৈশোর ও যৌবনে বিস্তৃত, বাবা-মা স্বপ্ন দেখতেন অপরাজিতা বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। পড়াশোনাতেও বেশ ছিলেন। তবে তার চোখের স্বপ্নটা ছিল অন্যরকম। রহস্য উদঘাটনে ছিল বিপুল আগ্রহ, অপরাজিতা চাইতেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ বা অনুসন্ধানী সাংবাদিক হতে। মূলত ছোটবেলায় পড়া প্রচুর গোয়েন্দা গল্পই তাকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছিল। তবে, সিনেমার পরিচালক হবেন এটা ঠিক পরিকল্পিত নয়। কিন্তু যেদিন থেকে স্বপ্ন দেখেছেন সিনেমা নিয়ে সেদিন থেকে সিনেমা সবচেয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন।
ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করা অপরাজিতার চলচ্চিত্র নির্মাণের হাতেখড়ি চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের কাছে। তার কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল জাপানে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাদের একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন তিনি। সেখান থেকে দেশে ফেরার পর কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে পেশায় তিনি একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ফটোগ্রাফার। এছাড়া ছোট্ট একটা প্রোডাকশন হাউজও আছে।
তার পরিচালক হয়ে ওঠার শুরুটা জাপানে থাকাকালীন সময়ে। চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’ চলচ্চিত্রে হাতে কলমে কাজ করার মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। যখন এই চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্য তানভীর মোকাম্মেল জাপানে গিয়েছিলেন, অপরাজিতা তানভীর মোকাম্মেলের সাথে দেখা করতে যান। শ্যুটিং সেটে গিয়ে দেখলেন সেটে পরিচালক খোদ নিজেই কাজ করছেন, এটা অপরাজিতাকে বেশ নাড়া দিল।
অপরাজিতা বলেন, বাংলাদেশে ঠিক এরকম একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই না, যে পরিচালক সেটে কাজ করছেন, তাও তানভীর মোকাম্মেলের মতো একজন বড়ো পরিচালক। আমিও সেখানে কাজ করার আগ্রহ অনুভব করলাম। এই সিনেমাতে আমি আমার জাপানের জীবন নিয়ে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। সেই প্রথম সিনেমার প্রতি আমি আমার আগ্রহটা উপলব্ধি করতে পারলাম। ২০১২ সালে যখন দেশে ফিরলাম, আমি অনুভব করলাম আমার আগ্রহটা দিনে দিনে বাড়ছে। মনে হল, আমিও সিনেমা বানাতে চাই, কিন্তু সিনেমা বানিয়ে ফেললাম বললেই তো বানানো যায় না। এটার জন্য পড়াশোনা প্রয়োজন, প্রয়োজন কাজ শেখা। এখন অবশ্য অনেকেই পড়াশোনা না শিখে, কাজ না শিখে সিনেমা বানিয়ে ফেলছে তারা বোধ করি বেশি মেধাবী। কিন্তু সিনেমা বানানোর ইচ্ছা তৈরি হওয়ার শুরুতেই আমার মনে হয়েছে সিনেমা নিয়ে জানতে হবে, বুঝতে হবে, শিখতে হবে। এর আগ পর্যন্ত সিনেমা বিষয়ক পড়াশোনা আমার ছিল না। এরপর আমি সিনেমার অ্যাপ্রিশিয়েশন কোর্স করলাম। কোর্স করতে গিয়ে দেখলাম আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। এরপর একটার পর একটা কোর্স করলাম। তারপর শুরু করলাম চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ।
পরিচালক হিসাবে তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুরুষাতঙ্ক’। প্রতিদিন চারপাশে অহরহ নারী নির্যাতনের ভয়াবহ সব ঘটনা দেখতে দেখতে একজন নারী নির্মাতা হিসেবে তিনি তার নারী সত্ত্বার কিছু অনুভূতিকে এই চলচ্চিত্রে তুলে ধরতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম, প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হবার ভয়, পুরুষের আক্রমণের আতঙ্ক, এসব গল্পই স্বল্প পরিসরে ফুটে উঠেছিল 'পুরুষাতঙ্ক' ছবিটিতে। অপরাজিতা বলেন, আজকাল অনেক নারী বিদ্বেষী সিনেমা হচ্ছে, সেগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পাচ্ছে! সেদিক থেকে 'পুরুষাতঙ্ক' পুরুষবিদ্বেষী সিনেমা ছিল না।'
তার নির্মিত প্রথম এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ আলোচনা– সমালোচনা হয়েছিল। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে 'পুরুষাতঙ্ক' নাম দেখেই অনেকে তার গায়ে 'পুরুষবিদ্বেষী', বলে ট্যাগ দিয়েছেন। বলেছেন, পুরুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন তিনি। ছবিটি দেখার পর অবশ্য বেশিরভাগেরই এই মনোভাব বদলেছে। এছাড়াও সেবার দেশের বাইরে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ৬টি পুরস্কার রয়েছে ‘পুরুষাতঙ্ক'-র ঝুলিতে। নিজের প্রথম কাজেই অপরাজিতা সফলতার মুখ দেখেছিলেন।
এরপর থেমে যাননি অপরাজিতা। একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে দর্শকদের বেশ অনেকগুলো কাজ উপহার দিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'রিভোল্ট', 'ছাড়পত্র'। 'রিভোল্ট' সিনেমার জন্য অর্জন করেছেন ১৯ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
২০২০ সালেই 'রিভোল্ট' ৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত 'তৃতীয় বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১'-এ 'বিশেষ জুরি পুরস্কার'টি অর্জন করেছে 'রিভোল্ট'। অপরাজিতা সংগীতার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়ে দর্শকদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে।
অপরাজিতা সংগীতা অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করেছেন, লেখালেখিও করেছেন। সাইবার ক্রাইমে নারীরা যে হয়রানির শিকার হচ্ছে, নারীরা যে ভিকটিম হচ্ছে তাদের সাহায্য করতে কাজ করে যাচ্ছেন অপরাজিতা।
তিনি বলেন, কোন মেয়ে যদি বিপদে পড়ে তার সাথে কোনো অন্যায় হয় তাকে প্রথমে কাউন্সিলিং করি, তারপর অন্য যেকোনো সহযোগিতা তাকে দেওয়ার চেষ্টা করি। এসব ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে অপরাজিতার মনে হয়েছে চলচ্চিত্র খুব শক্তিশালী একটা মাধ্যম। কোনও বিষয়ে লিখে বা বলে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেয়ে চলচ্চিত্র মাধ্যমে বেশি সহজে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা এবং চলচ্চিত্র নিয়ে তার আগ্রহ; দুটো মিলিয়েই এ পথে তার যাত্রা শুরু।
শুধু মানুষকে বিনোদিত করা কিংবা বাণিজ্যিক কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি শিল্পমানসম্মত এবং বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। তার কাজের মধ্যেই ঘুরে ফিরে নারী ইস্যু, সমাজের নানান অসঙ্গতি, বৈষম্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরতে চান।
চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি অপরাজিতা যেমন বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত আছেন তেমনি তিনি নানা সেবামূলক কাজের সাথেও যুক্ত। পথশিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম 'প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন', বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবার ক্ষুধার্তদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার প্রজেক্ট ‘ফুড ব্যাংকিং’, জরুরি রক্তদান কার্যক্রমসহ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো কিছু কাজের সাথে তিনি দীর্ঘদিন যাবত যুক্ত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তিনি করেছেন তা হল মরণোত্তর চক্ষুদান এবং মরণোত্তর দেহদান।
অপরাজিতা সংগীতা নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ করছেন। শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় তানভীর মোকাম্মেলকে নিয়ে বায়োপিক নির্মাণ করছেন, খুব দ্রুত ই সিনেমাটির নির্মাণকাজ শেষ হবে এবং দর্শক দেখতে পাবেন বলে জানান অপরাজিতা। এছাড়াও তার নতুন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রি-প্রোডাকশন চলছে।
প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবারও কাজের জন্য কীভাবে প্রস্তুত করেন জানতে চাইলে অপরাজিতা বলেন, থেমে যাওয়া তো কোনো সমাধান না। থেমে গেলে তো সবই থেমে গেল। মেয়েদের তো থামাতেই চাওয়া হয়, কিন্তু সেটা কেন আমি হতে দিবো? আমার কাছে শক্তি এটাই যে, আমাকে তো থামাতে চাওয়া হয়, আমি থেমে গেলে তো তাদের জিতিয়ে দেওয়া হল। ছোটোবেলা থেকেই বাবা যে মন্ত্র দিয়েছিলেন, নিজের জায়গা তৈরি করা এবং মানুষের জন্য কাজ করা সেই মন্ত্রই আমার কঠিন ও প্রতিকূল সময়ে আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।
বিবার্তা/এসবি/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]