"জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ
অমৃতের স্পর্শ চায়; অন্ধকারময়
ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি’
উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ-শিখা
জ্বালাময় আত্মার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী
আপনারে দগ্ধ করে প্রচণ্ড বিস্ময়ে।"
বলেছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তার কবিতার চরণের মতোই তারুণ্যের স্পৃহা, অপ্রতিরোধ্য গতি ও মেধার অসাধারণত্ব নিয়ে বিকশিত এবং সম্ভাবনায় এগিয়ে চলা বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণ মিঠুন কুমার আচার্য্য। যিনি অসাধারণ মেধার স্বাক্ষরে সমুজ্জ্বল এবং নিজস্ব কর্মপরিধির বিস্তৃতিতে ক্রমেই পরিচিত হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মেধাবী এক মুখ। মিঠুন মেধা, প্রচেষ্টা ও দক্ষতার চমৎকারিত্বে প্রথমে দেশকে করেছেন আলোকিত। পরবর্তী সময়ে দেশের পরিধি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে প্রমাণ করে চলেছেন নিজের মেধা ও অধ্যবসায়। ক্রমেই বিস্তৃত করছেন নিজেকে গবেষণাধর্মী কাজের পরিধিতে।
মিঠুন কুমার আচার্য্য বর্তমানে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বার্মিংহামে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন জৈব পরিসংখ্যান বিভাগ ব্লেজার রিসার্চ ফেলো হিসেবে।
নিজের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে মিঠুন প্রমাণ করেছেন বারবার এবং নানা ক্ষেত্রে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বার্মিংহামের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োস্ট্যাটিস্টিকস পিএইচডি প্রোগ্রামে অসাধারণ একাডেমিক রেকর্ড হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ব্লেজার গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়েছেন। পঞ্চম বার্ষিক টেক্সাস স্টেম কনফারেন্সে পেপার উপস্থাপন করেছেন এবং কনফারেন্স টক ক্যাটাগরিতে ১ম স্থান অধিকার করে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। নির্বাচিত হয়েছেন Pi Mu Epsilon, National Honorary Mathematics Society-তে (টেক্সাস বিটা অধ্যায়)।
এর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান, জীব পরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে এমএস-এ অসামান্য কৃতিত্বের জন্য কাজী মোতাহার হোসেন স্বর্ণপদক পেয়েছেন ২০১৩ সালে। বিএস (সম্মান) পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের পক্ষ থেকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ২০১১ সালে। অর্থাৎ, মিঠুনের মেধা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়।
মিঠুন কুমার আচার্য্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান, জীব পরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে উল্লেখযোগ্য সিজিপিএ পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ২০১১ সালে কৃতিত্বের সাথে বিএস (অনার্স) সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান, জীব পরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে রেকর্ড সিজিপিএ পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ২০১৩ সালে। সেসময় তিনি থিসিস করেন ফার্মাকোকাইনেটিক স্টাডির জন্য ননলিনিয়ার কম্পার্টমেন্টাল মডেল : স্থির এবং মিশ্র প্রভাব মডেল নিয়ে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের লামার বিশ্ববিদালয় থেকে গণিত বিভাগ থেকে বায়ুর গুণমান এবং ফুসফুসের ক্যান্সার : স্থানীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্লেষণ এর উপর থিসিস করে আবারও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পুনরায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিফরমেট্রিকা ব্যবহার করে পরিসংখ্যানগত আকার বিশ্লেষণ : গড় আকার এবং অনুমান করা জিওডেসিক আকৃতির গতিপথ নিয়ে গবেষণা করে, সেখানেও তিনি স্বাক্ষর রাখেন কৃতিত্বের। বর্তমানে পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বার্মিংহামে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মিঠুন সত্যিকার অর্থেই একজন মেধাবী তরুণ, দুর্বার গতিতে যার ছুটে চলা মেধাকে প্রমাণ করতে। এটা সহজেই অনুমেয় হয়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার পড়াশোনা ও পরীক্ষার ফলাফল দেখলেই। একবার নয়, তিনবার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। তার এই অধ্যবসায় নিঃসন্দেহে চমক লাগিয়ে দেবার মতো। শুধু স্নাতকোত্তর নয় বারবারই নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ছেন। তার মেধা বাংলার সম্পদ বৈকি।
এবার চলুন একটু পেছনে ফিরে যাই, মিঠুনের শৈশবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে কুমিল্লা শহরের ছোট্ট ছিমছাম মধ্যবিত্ত একটি পরিবার। সদস্য বলতে মিঠুন কুমার আচার্য্যের মা, বাবা, বোন এবং সে নিজে। চারজনের পরিবারটি স্নেহ-মায়া-ভালোবাসায় ছিল নিবিড়ভাবে জড়িয়ে, পরিবারটিতে ঠিক ততটাই ছড়িয়ে ছিল শিক্ষা ও আদর্শের সুবাতাস। সে বাতাসে মিঠুন ও তার ছোটোবোনের জীবনযাপনের শ্বাস-প্রশ্বাস। মিঠুনের বাবা-মা দুজনেই শিক্ষাসংশ্লিষ্ট পেশায় নিযুক্ত বলে পারিবারিক আবহটাই ছিল শিক্ষা-সংস্কার-চেতনার নিবিড় ছোঁয়ায় জড়ানো।
মিঠুনের মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাবা থানা শিক্ষা অফিসার ছিলেন। তাদেরই স্নেহছায়ায় মেধা নিয়ে উজ্জ্বল জীবনের স্বপ্ন বুনে বুনে বেড়ে ওঠা এবং এগিয়ে চলা আজকের মিঠুন কুমার আচার্য্যের।
ছোটবেলায় ভীষণ ডানপিটে মিঠুন ছিলেন বাবা-মায়ের ভীষণ আদরের। জন্ম ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে হলেও বেড়ে ওঠা কুমিল্লাতে। মূলত বাবার চাকরিস্থল ছিল কুমিল্লা, তাই কুমিল্লাতেই শৈশব কেটেছে। মিঠুন বলেন, দুরন্ত হলেও পড়াশোনাতে বেশ আগ্রহ ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মেধাস্থান করি। এইচ. এস. সি পরীক্ষায় আবদুল মজিদ কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পাই। সুতরাং ছোটো থেকেই মেধাবী আজকের মিঠুন।
বাবা-মা দুজনেই অনেক কেয়ার করতেন পড়াশোনা নিয়ে। তবে, বাবা আমার অনুপ্রেরণা ভাল কিছু করার জন্য। বাবা অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। দারিদ্র তাঁকে খুব বেশি দূর যেতে দেয়নি। তাই তিনি সবসময় চাইতেন আমি যেন পড়াশোনা করে অনেকদূর যাই।
মিঠুন জানান, হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার। কোনো কারণে আর ডাক্তার হয়ে ওঠা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পড়ার বিষয় হিসেবে পরিসংখ্যান নেই। তেমন বেশি কিছু জানা ছিল না পরিসংখ্যান নিয়ে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ভালো কিছু করার ইচ্ছে জাগে। প্রথম বর্ষ থেকেই ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। সেই মতো পড়াশোনা এবং ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হই।
মিঠুন কুমার আচার্য্যের বিশেষভাবে দক্ষতা রয়েছে সফটওয়্যার এবং সহজ ও জটিল পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে। তিনি ২০২২ সালে বার্মিংহামে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস অফ সার্ভিস লার্নিং এবং আন্ডারগ্রাজুয়েট রিসার্চ আয়োজিত রিসার্চ এক্সপো-তে বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও, ২০১৯ সালে পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যান বিভাগে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। লামার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে গণিত ল্যাব টিউটর হিসেবে কাজ করেছেন ।
দেশে থাকাকালীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগে পরিসংখ্যানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও মিঠুন কুমার আচার্য্য টিচিং ফেলো হিসেবে ছিলেন (বায়োস্ট্যাটিস্টিকস I) ডক্টর সোরিনা ইফটিম, এনভি বিভাগের অধীনে রোমেন্টাল এবং অকুপেশনাল হেলথ, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।
প্রবাসে যাওয়া প্রসঙ্গে মিঠুন জানান, ২০১৬ সালে আমার যুক্তরাষ্ট্রে আসা, উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে। বর্তমানে বায়োস্ট্যাটিস্টিক-এ পিএইচডি করছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর শিক্ষকতা করেছি। শিক্ষকতা পেশাটিকে আমি খুবই পছন্দ করি। আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিতে চাই শিক্ষার্থীদের। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নিজেকে আরো প্রস্তুত করে তুলতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রচেষ্টা এবং বিদেশে আসা। আমি দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি দেশকে কিছু দিতে চাই, শিক্ষার্থীদের জন্যও সর্বোচ্চ আন্তরিকতাই আমার লক্ষ্য।
ব্যক্তিজীবন নিয়ে মিঠুন বলেন, আমি বিয়ে করি ২০১৬ সালে। আমার সহধর্মিণী আমার জন্য খুব স্ট্রং একটা সাপোর্ট। তার নাম অনামিকা, সে নিজেও ম্যানেজমেন্টে পিএইচডি করছে। তার সাপোর্ট না পেলে আমার এগিয়ে যাওয়াটা দুষ্কর ছিল। আমরা একইসাথে পরস্পরের দুঃখ-সুখের ভাগীদার এবং পড়াশোনাতেও নিজেরা নিজেদের সাপোর্ট করি।
মিঠুন আরো বলেন, দেশের প্রতি টান প্রতিটা মানুষেরই থাকে, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর সে টান আরো গভীর হয়৷ আমি ভীষণভাবে সেই টান অনুভব করি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে আমার কাছে কী এবং কতটা আমি তা বিদেশে এসে অনুভব করেছি। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে অনেকদূর এগিয়ে যাবে, সেই স্বপ্নযাত্রায় শামিল হতে চাই নিজেও। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে আমাদের, তবু সেসব ফেলে এগিয়ে যাবে দেশ এই আমার স্বপ্ন। রাজনীতির কলুষতামুক্ত শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে, নিদারুণ সেই স্বপ্নে মশগুল প্রতিভাবান এই তরুণ মিঠুন কুমার আচার্য্য।
বিবার্তা/এসবি/সউদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]