গণহত্যা নভেম্বর-১৯৭১
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১১:২৩
গণহত্যা নভেম্বর-১৯৭১
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাকে বিনাশ করতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। পরবর্তী ৯ মাস ধরে তারা বাঙালি নিধন অব্যাহত থাকে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন বলা হলেও, বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, হত্যা ছাড়াও ছয় লাখেরও বেশি নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে। দেশজুড়ে আনাচে-কানাচে নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েছে অসংখ্য মানুষ।



পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসররা কত ঘরবাড়ি সম্পদ ভস্মীভূত করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তারও প্রকৃত হিসাব নেই। তবে এসব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশই ঘটেছে রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের সহায়তায়।


এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর।



১৯৭১-এর নভেম্বর মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন যে সব স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয় :


ধনুট গণহত্যা (বগুড়া) : বগুড়ার ধুনট উপজেলায় ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।


হাতিয়া গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর কুড়িগ্রামের উলিপুরে পাক-হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলসামস বাহিনীর সহযোগিতায় নিরীহ ৬৯৭ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে।


১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ,২৩ রমজান; শনিবার ফজরের নামাজের আজান ধ্বনিত হচ্ছে মসজিদে মসজিদে। হঠাৎ পাকিস্তানি হায়েনার মর্টার সেল আর বন্দুকের অবিরাম গুলিবর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে হাতিয়ার দাগারকুটি গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলসামস বাহিনী মিলে গ্রামের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর সঙ্গে চলতে থাকে লুটপাট ও নির্যাতন। তারা আত্মগোপন করা মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে এসে দাগারকুটিতে জড়ো করে হাত-পা বেঁধে নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর, দাগারকুটি, হাতিয়া বকসি, রামখানা ও নয়াদাড়া গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি।


তেরশ্রী গণহত্যা : ২২ নভেম্বর ১৯৭১, মানিকগঞ্জের ঘিওরের তেরশ্রীতে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন পাক-হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে এবং বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে চাওয়ায় ঘাতকরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকে।


এ সময় তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান এগিয়ে যান ঘটনাস্থলে। তিনি জানতে চান জমিদার বাবুকে হত্যা করা হচ্ছে কেন? হায়েনার দল তখন অধ্যক্ষকে ধরে নিয়ে আসে তেরশ্রী বাজারে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত হানাদার বাহিনী এবং দোসররা হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ সম্পন্ন করে ফিরে যায় ঘিওরে। লাশের গ্রামে পরিণত হয় পুরো তেরশ্রী গ্রাম। পরে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান মিলে লাশগুলোকে কবর দেয়।


সূর্যদী গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর শেরপুরের সূর্যদী গ্রাম ও আশপাশের এলাকা ভেসেছিল রক্তের বন্যায়। এদিন বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৩০০ ঘরবাড়ি।


সেদিন সকাল ৭টায় জিপ আর ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে হামলে পড়ে। লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী ছুড়তে থাকে। একই সময়ে গান পাউডার ছিটিয়ে এ গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আর গ্রামের যুবক-কিশোর যাদের পায় তাদের ধরে এনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার জন্য দাঁড় করায় স্থানীয় ধানক্ষেতের মধ্যে। ওইদিন আত্মগোপন করে থাকা এ গ্রামেরই বাসিন্দা ৬ বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন সামনে এগিয়ে আসেন। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর। একটু পরেই তাদের সঙ্গে যোগ দেন অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা কোম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুটি দল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে হানাদাররা দ্রুত পিছু হঠে যায়। এ যুদ্ধেই শহীদ হন খুনুয়া চরপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আফসার আলী।


বক্তাবলী গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর, দেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চল বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামে। বর্বরোচিত ওই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ১৩৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি নারী কিংবা শিশু। রাজাকার, আলবদররা জ্বালিয়ে দিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। স্বাধীনতাযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে একসঙ্গে এত মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি আর নেই। ঘটনার দিন ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পাক-বাহিনী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ চলাকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন বক্তাবলীতে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিলে তাদের শক্তি বাড়ে। পরে তারা একত্রে পাক-বাহিনীর সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ চালান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন।


বক্তাবলীর মানুষ শত শত মুক্তিযোদ্ধার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সঙ্গে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে পালিয়ে আসা শত শত পরিবারের আশ্রয়স্থল ছিল বক্তাবলী। পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র ১৭ দিন আগে ঘটে বক্তাবলীর হৃদয় বিদারক হত্যাযজ্ঞ।


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছে, সম্ভ্রম হারিয়েছে, স্বজন-সম্পদ হারিয়েছেন, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা কখনও ভুলে যাবার নয়। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা।


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com