'মিলনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে শান্তি পাবে শত শহীদের আত্মা'
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৩২
'মিলনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে শান্তি পাবে শত শহীদের আত্মা'
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

‘গুলিবিদ্ধ শহর করছে অশ্রুপাত অবিরত/ কেননা মিলন নেই। দিনদুপুরেই নরকের/শিকারি কুকুর তার বুকে বসিয়েছে দাঁত, বড়/নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ।…’ কবি শামসুর রাহমান ‘মিলনের মুখ’ শিরোনামে কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর।


ততদিনে মিলন হয়েছেন এদেশের ইতিহাস, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়ার প্রেরণা, যার বুকের রক্ত সেদিন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল, সামরিক স্বৈরশাসককে বাধ্য করেছিল পদত্যাগ করতে।


আজ ২৭ নভেম্বর, শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ৩৩তম মৃত্যুদিবস। ১৯৯০ সালের এই দিনে ডা. মিলন চলমান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনের সড়কে গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুবরণ করেন।শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে দাফন করা হয়।


এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র রূপ লাভ করে। একই সময়ে এরশাদ সরকারের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল এবং ২৩ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন চলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতৃত্বে। এদিন কর্মসূচি ছিল সারাদেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে জরুরি চিকিৎসা বহাল রেখে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং তৎকালীন আইপিজিএমআর বা পিজি হাসপাতালের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) বটতলায় বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশ। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনের সঙ্গে একই রিকশায় পিজি হাসপাতালের সভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ডা. মিলন। রিকশাটি টিএসসি চত্বরের সামনে পৌঁছাতেই সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর গুলিতে ডা. মিলন শহীদ হন। দিনটি ছিল মঙ্গলবার, সময় বেলা ১১টা হবে। সঙ্গে সঙ্গেই মিলনকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং মিলনের মৃত্যু হয়।


মিলনের শহীদ হওয়ার সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনরত ছাত্রসংগঠনসহ সব পেশাজীবী সংগঠন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে। সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনের অবসানধ্বনি বেজে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে তীব্র ছাত্র ও গণ-আন্দোলন এবং রচিত হয় ছাত্রগণ-অভ্যুত্থান। ফলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।


ডা. শামসুল আলম খান মিলন ১৯৫৭ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৫ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন মিলন। এরপর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।


মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে মিলন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।


ডা. মিলন ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক এবং ১৯৮১ সালে ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ডা. শামসুল আলম খান মিলন ১৯৮৮ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআর থেকে প্রাণরসায়নে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি বিএমএ’র যুগ্ম সম্পাদক পরে চিকিৎসক পেশাজীবীদের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ও শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।


১৯৮২ সালে সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে গড়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ফলে আন্দোলনের শুরু থেকেই মিলনও এগিয়ে আসেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রথম তীব্র প্রতিবাদ ছিল মজিদ খানের শিক্ষানীতিবিরোধী ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন। এ আন্দোলনেও ডা. শামসুল আলম খান মিলন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।


এরশাদের শাসরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতেই মিলন ছিলেন সবার পরিচিত মুখ। ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসনের অবসান ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন নতুন পথে এগুতে থাকে। সেই আন্দোলনসহ ১৯৮৬ সালের ভোট চুরির নির্বাচন এবং ১৯৮৭ সালের ঢাকা অবরোধ আন্দোলনেও ডা. মিলন ছিলেন পুরোভাগে।


মিলনের মৃত্যুর সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের মানুষ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। জনগণের ক্ষোভ দমাতে এরশাদ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। সন্ধ্যা থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজ ও চিকিৎসকদের নেতৃত্বে জনগণ কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসে। অবশেষে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।


ডা. মিলন রক্ত দিয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এবং মানুষের বন্দি দশা ঘোচানোর স্বপ্নে। তার রক্তদানের ভেতর দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে, দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু স্বৈরাচারী সামরিক শাসকরা থেকে যায় নিরাপদে। তাই বারবার গণতন্ত্র পড়ে হুমকিতে, বারবার জনগণ তার অধিকার হারায়। দীর্ঘ ৩৩ বছর নির্বাচিত সরকারের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে দেশ, কিন্তু যে চেতনায় লড়াই সংগ্রাম হয়েছিল রাজপথে, যে চেতনায় মিলন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তা থেকে যায় অধরা।


‘এ শহর ছিল শৃঙ্খলিত, ভয়ংকর শৃঙ্খলিত/প্রতিটি মানুষ, ঘরদোর, গাছপালা পশুপাখি;/শেকল ভাঙার গানে কণ্ঠ মেলাতে মিলন নিজে/আগুন-ঝরানো গান হয়েছিল তপ্ত জনপথে।’ মিলনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক এদেশে, তাহলেই শান্তি পাবে মিলনসহ শত শহীদের আত্মা।


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com