১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর রাজপথে জ্বলন্ত স্লোগান হয়ে এসেছিলেন নূর হোসেন। তার বুকে-পিঠে লেখা ছিল “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। এরশাদের স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেন।
এরশাদের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সেদিন ১০ নভেম্বর ছিল ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। এই কর্মসূচি সফল করতে নূর হোসেন বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে নেমেছিলেন রাজপথে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখলের পর থেকে প্রায় পাঁচ বছর লাগাতার আন্দোলন চলেছে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে। তখন পর্যন্ত এই অর্থবহ ও আবেদনময়ী স্লোগানটি শোনা যায়নি। নূর হোসেন প্রথম জীবন্ত পোস্টার হয়ে এ স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করে সারাদেশে তিনি সামরিক শাসন জারি করেন।
১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এদেশের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ সময়ে এরশাদ এক শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন, যা মজিদ খানের শিক্ষানীতি হিসেবে পরিচিত। গণবিরোধী সেই শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে সামরিক শাসন উপেক্ষা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, অনেকে এই দিনটিকে পালন করেন স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
এই দিনেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। সেদিন এক বিশাল ছাত্রমিছিল শিক্ষাভবন অভিমুখে রওনা হলে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। এ মিছিলে শহিদ হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ আরও অনেকে। গড়ে ওঠে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাতদলীয় ঐক্যজোট। রাজনৈতিক জোটের বাইরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নূর হোসেনের মৃত্যুর পর আন্দোলন আরও বেগবান হয়। লাগাতার হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। স্বৈরাচার এরশাদ আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একের পর এক কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সব সংসদ সদস্য দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এরশাদের পতনকে নিশ্চিত করতে বিরোধী সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেন। একপর্যায়ে এরশাদ সংসদ ভেঙে দিয়ে ১৯৮৮ সালের ৮ জানুয়ারি নির্বাচন ঘোষণা করেন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আট দল, সাত দল ও পাঁচ দল নির্বাচন বর্জন করে। তখন থেকে শুরু হয় জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে লাগাতার ছাত্র আন্দোলন।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে । দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনরে মুখে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ইতিহাসে তা নব্বইয়ের গণআন্দোলন হিসাবে পরিচিত।
নূর হোসেনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ১৯ বছরের যুবক ইকরাম হোসেন। তিনি ঢাকার রাজধানী সুপার মার্কেটের কাছে ‘আর্ট হ্যাভেন’ নামের একটি ছোট দোকানের মালিক। নূর হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। ১৯৮৭ সালের ৮ নভেম্বর নিজের দোকানে বসে কাজ করছিলেন ইকরাম। সকালবেলা কয়েকজন সঙ্গীসহ সেখানে হাজির হন নূর হোসেন। একটি কাজ করে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ জানান। ইকরাম তখন বেশ ব্যস্ত। নূরকে পরদিন আসতে বললেন। নূর যথারীতি এলেন ৯ নভেম্বর বিকালে। তিনি ইকরামকে নিয়ে গেলেন ক্যাফে চায়নার গলির পাশে। খুলে ফেললেন গায়ের জামা; বললেন, ‘আজ আপনি এমন কিছু কথা লিখবেন, যা আগে কখনও লেখেননি।’ নূর জানালেন, লিখতে হবে তার শরীরে। পাশের দেয়ালে তিনি চক দিয়ে লিখলেন, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ঠিক এই বানানে। তারপর এ কথাগুলো লিখে দিতে বললেন তার বুকে-পিঠে ।
ইকরাম হোসেন প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কম্পিত হাতে তিনি তুলি তুলে নিলেন, সাদা অ্যানামেল পেইন্টের কৌটার মুখ খুললেন এবং তারপর মিনিট বিশেকের মধ্যে লিখে ফেললেন সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। (সূত্র: সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দীপংকর চন্দ)। পরদিন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ১৪৪ ধারাকে তর্জনী দেখিয়ে জনতার ঢলে মিশে গেলেন নূর।
নূর হোসেন নামের এই জীবন্ত পোস্টার দেখে স্বৈরশাসকের রক্ষক পুলিশবাহিনী সহ্য করতে পারেনি। গুলি করে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল নূর হোসেনকে। পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন ঢলে পড়েন জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টের কাছে, আর নিজের রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে দেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দল এবং জাসদ, বাসদসহ পাঁচ দলের লিয়াজোঁ কমিটির ডাকে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ছিল সেদিন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে শুরু হয় সরকার পতনের আন্দোলন। ক্রমেই আন্দোলন হতে থাকে বিস্তৃত ও বেগবান। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় আন্দোলনে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধের ডাক দেয় পাঁচ, সাত ও আটদলীয় জোট।
কর্মসূচি ব্যর্থ করতে এরশাদ ৯ থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করেন। এমনকি চারজনের বেশি মানুষের একসঙ্গে চলাফেরার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। হাজারো মানুষের মিছিলের ঠিকানা তো সচিবালয় ও তার আশপাশ। এমনই একটা মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন নূর হোসেন। পরদিন মিছিলটি গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে পৌঁছার পর পুরোভাগে থাকা নূর হোসেনের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ, বেগবান হয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন।
নূর হোসেন ১৯৬৪ সালে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেয়। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তার বাবা মুজিবুর রহমান সপরিবারে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে চলে আসেন।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণির পর নূর হোসেনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর গাড়ির মেকানিক হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। নূর হোসেনের মৃত্যুর পর ৩৬ বছর কেটে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? আজও রাজপথে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চলছে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাত বছরের মধ্যে স্বৈরশাসক এরশাদ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি তৈরি হয়েছিলেন। আন্দোলনকারী দলগুলো রাজনৈতিক কৌশলের নামে এরশাদকে কাছে টেনে নিয়েছে। মাত্র পাঁচ বছর কারাবাস থেকে এরশাদ মুক্ত হয়েছিলেন নানা মামলা থেকে । রক্ষা পেয়েছেন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহা, রাউফুন বসুনিয়া, সেলিম, দেলোয়ার, তাজুল, মুন্না, ডাক্তার মিলনসহ অসংখ্য জীবন কেড়ে নেয়ার অপরাধ থেকে। আর একের পর এক শহিদরা পরিণত হয়েছেন স্লোগানে। সেই স্লোগানের ভিড়ে শহিদ নূর হোসেনও আজ শুধুই একটি স্লোগান। যে স্লোগান স্বৈরশাসনসহ সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি ও অনুপ্রেরণা জাগিয়ে যাবে।
লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ
বিবার্তা/এসবি/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]