প্রতিষ্ঠার ৩১ বছরে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১০
প্রতিষ্ঠার ৩১ বছরে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

গত ২১ অক্টোবর ২০২৩ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠা লাভের পর দেশব্যাপী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধিভূক্ত প্রায় ২২৫৭ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে পথ চলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের মানচিত্রসম এর ব্যাপ্তি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৩৫ লক্ষ শিক্ষার্থী ও ১ লক্ষ শিক্ষক যা গোটা পৃথিবীর ১০৪টি দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশী। পৃথিবীর বৃহত্তম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সূতিকাগার। অধিকাংশই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। এরা মেধাবী অথচ আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। উচ্চশিক্ষায় এদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে তার নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন, “দারিদ্র যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবীদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে”।


এক সময়ে সেশনজটে আকন্ঠ নিমজ্জিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ এর মাধ্যমে ২০১৯ সালে সম্পূর্ণ সেশনজটমুক্ত হয়। সেশনজট শূন্যের কোঠায় নেমে আসার সংগে সংগে দেখা দেয় অতিমারী করোনা। স্থবির হয়ে পড়ে অর্থনীতির চাকা। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বব্যাপী সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শত শত মানুষের মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে দেয়া হয় লকডাউন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার সারাদেশের অধিভুক্ত কলেজসমূহের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখতে চালু করে অনলাইন ভিডিও লেকচার। কলেজে কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তায় তৈরী করা হয় ডিজিটাল ষ্টুডিও। ৩১টি সাধারন বিষয়ে ১৪৬৮টি কোর্সের ওপর রিসোর্স পার্সন নিযুক্ত করে তৈরি করা হয় ১৭৫০০ ভিডিও লেকচার। আপলোড করা হয় ওয়েবসাইটে। ব্যান্ডউইথ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এগুলো পৌছে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছে । অনলাইনে নেয়া হয় মৌখিক পরীক্ষা। এশিয়ার অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাকালীন এত সংখ্যক অনলাইন ভিডিও তৈরী ও আপলোডের নজির নেই।


করোনাপূর্ব ২০১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রথম অধ্যক্ষ’ সমাবেশে বলেন, ‘শিক্ষা একটি ধারাবাহিক বিষয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে এবং শিক্ষার নতুন নতুন বিষয় বেছে নিতে হবে’। এ বছরের ১৬ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র, মেধাবী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে এসে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার গুনগত মান পরিবর্তন করতে হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও কর্মমূখী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য চাই বিশ্ব মানের নতুন নতুন বিষয়। বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সারাদেশের কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এসময় একাডেমিক মাষ্টার প্ল্যান, ফিজিক্যাল মাষ্টার প্ল্যান, আইসিটি মাষ্টার প্ল্যান, অন-ক্যাম্পাস অনার্স ও অন-ক্যাম্পাস পিজিডি প্রোগ্রামসহ মোট ১০টি প্রকল্পের শুভ উদ্ভোধন করেন।


প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শকে ধারণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে দক্ষ ও কর্মমূখী করে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সম্প্রতি চালু করেছে ১২ টি স্কিল-বেইসড পোষ্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম। অন-ক্যাম্পাস এমএএস প্রোগ্রামের পর সারাদেশে পরিচালিত উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে মনিটরিং এর জন্য এবারই প্রথম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ ক্যাম্পাসে চালু করা হয়েছে অনার্স প্রোগ্রাম। উল্লেখ্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কোনো নতুন বিষয়ে অনার্স চালু করেনি। শুধুমাত্র যে বিষয়গুলোর অধিভূক্তি রয়েছে, সেগুলোই ক্রমান্ময়ে অন-ক্যাম্পাসে চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে একাডেমিক মাষ্টার প্ল্যানে।


ইতোমধ্যে ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট ও একাডেমিশিয়ানদের সমন্বয়ে ডেভেলপ করা হয়েছে ১৯টি স্কিল-বেইসড শর্টকোর্স যা অ্যাম্বেডেড আকারে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ করতে হবে। আইসিটি ও সফট-স্কিল পাঠদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এলক্ষ্যে সারাদেশের শিক্ষকদের সিইডিপি প্রজেক্টের আওতায় দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষন। শিক্ষকদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে রিসার্চ গ্র্যান্টস। নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে দুটো জার্নাল ও একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা। শিক্ষকদের জন্য রয়েছে পুস্তক রচনা ও প্রকাশনা প্রকল্প। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করতে কলেজে কলেজে আয়োজন করা হচ্ছে বিজ্ঞান মেলা। চাকুরী সুবিধার জন্য স্থানীয়ভাবে আয়োজন করছে যব ফেয়ার। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রিড়া চর্চা প্রসারে ভারত ও মালয়েশিয়া অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে করা হয়েছে নেটওরার্কিং অ্যান্ড কোলাবোরেশন। শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেমের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে বাধ্যাতামূলক করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাস পাঠ। বাংলাদেশের জন্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট। চালু করা হয়েছেএম ফিল পি এইচ ডি প্রোগ্রাম। গোপালগঞ্জের টুংগিপাড়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমিতে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু যাদুঘর ও লাইব্রেরী।


বিশ্বব্যাংক ও সরকারের সহযোগিতায় ইতিমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, ডরমিটরি ভবন, সিনেট ভবন, মেডিক্যাল সেন্টার, আইসিটি ভবন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রণীত হয়েছে অ্যাকাডেমিক মাষ্টার প্ল্যান, ফিজিক্যাল মাষ্টার প্ল্যান, বেন্ডেড এডুকেশন রোড ম্যাপ। নিজস্ব অর্থায়নে তৈরী করা হচ্ছে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিষ্টেম। সিইডিপি প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত মোট ১২২টি কলেজকে ল্যাব ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে প্রদান করা হয়েছে ইন্সটিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট গ্র্যান্টস। নিয়মিত করা হয়েছে ভাইস চ্যান্সেলর পুরস্কার, মডেল কলেজ পুরস্কার। মানচিত্রসম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয় বিভাগীয় শহরে অবস্থিত আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে। পরীক্ষার উত্তরপত্র বিতরণ ও সংরক্ষণসহ নানাবিধ কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এই প্রথম বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনলাইনে পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চালু করা হয়েছে এক্সাম ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার (ইএমএস)। ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আমেরিকায় অবস্থিত সমমনা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথ কোলাবোরেশনে চলছে নানান একাডেমিক ও কালচারাল একচেঞ্জ প্রোগ্রাম।


প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পুরুনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, নম্বরপত্র, সনদ, মাইগ্রেশন, টেন্ডার, শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানসহ সকল কাজ অন-লাইনে সম্পন্ন হচ্ছে। সেবা গ্রহীতাদের দ্রুত ও কার্যকর সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ওয়ান ষ্টপ সার্ভিস সেন্টার। মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান সময়ের অগ্রাধিকার। শিক্ষকরা হচ্ছে মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের প্রশিক্ষিত করলেই নিশ্চিত হবে শিক্ষার মান। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে মালয়েশিয়ার নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য ৫বছর মেয়াদী প্রকল্প চলমান আছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি ও তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নকরনের লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিপ্রদান কার্যক্রম চালু করেছে। বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে মেধাবী কিন্তু আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রীর কাঙ্ক্ষিত দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর। আর এভাবেই আমাদের আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলবে স্মার্ট বাংলাদেশ।


শেষ করবো ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবকালের একটি উক্তি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু বলেন, “...স্বাধীন বাংলাদেশে যে সম্পদ আছে যদি গড়তে পারি, অনেস্টলি কাজ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের কষ্ট একদিন দূর হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ”। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে শিক্ষায় বহুমাত্রিক অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে আরো কয়েক বছর। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনার বাংলার দাড়প্রান্তে পৌঁছে যাবে, এটি প্রমাণিত।


লেখক: ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com