বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ; রিটের পক্ষে কিছু কথা
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:১০
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ; রিটের পক্ষে কিছু কথা
সুশান্ত দাস গুপ্ত
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধে সম্প্রতি আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। সাবেক ছাত্র রাজনীতিবিদ হিসেবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যুক্তি ও তার গুরুত্বের বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি।


বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আমাদের সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় এক গভীর প্রশ্ন তুলে ধরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হলো এবং এর পেছনের যুক্তি কী? ছাত্র রাজনীতি আসলে কি শিক্ষার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, নাকি এটি প্রজন্মকে সচেতন ও দায়িত্ববান নাগরিক গঠনের অন্যতম মাধ্যম?


শুরুতেই ছাত্র রাজনীতির ধারণা ও তার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। ছাত্র রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রসার এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে সংযোগ স্থাপন করা। এটি ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা এবং সামাজিক উন্নয়নে তাদের অবদান বৃদ্ধি করার অপরিহার্য উপায়।


অতীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি মাইলফলকে ছাত্র রাজনীতি ছিল প্রেরণার অন্যতম উৎস। এই ইতিহাস আমাদের দেখায়, ছাত্র রাজনীতি কেবল ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও প্রগতির প্রতীক। তবে, বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্ট। কিছু ক্ষেত্রে, ছাত্রনেতারা সহিংসতা ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে, এটি কি সমস্যার সমাধান, নাকি সমাধানের সাময়িক পথমাত্র। বাস্তবে, সহিংসতা এবং অসামাজিক কার্যকলাপ ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য নয়; এটি সমাজের বৃহত্তর সমস্যার প্রতিফলন মাত্র।


আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানিক মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের রাজনৈতিক সচেতনতা ও কার্যকলাপে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েট তার শিক্ষার্থীদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব এবং নেতৃত্ব বিকাশের পথ রোধ করছে বলে আমি মনে করি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সমাজে বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দানের প্রস্তুতিতে অপরিহার্য। রাজনৈতিক চর্চা ও কার্যকলাপে অংশগ্রহণ তাদের এই দায়বদ্ধতার ভিত্তি স্থাপন করে, যা সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে অপরিহার্য।


শিক্ষার পরিবেশ ও মতামতের স্বাধীনতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈচিত্র্যময় ধারণা এবং চিন্তার স্বাধীনতা উন্নত হয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে এই স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার পথ রুদ্ধ হয়- যা শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণআন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে ওইসব ঐতিহাসিক ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়। ছাত্র রাজনীতির নামে সহিংসতা ও অস্থিরতার ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক হলেও, সমস্যার সমাধান হিসেবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ নয় বরং সুশৃঙ্খল ও শিক্ষামূলক পরিবেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপ, আন্দোলন পরিচালনার জন্য নীতিমালা ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করা উচিত। এই প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের রাজনীতিকে শিক্ষামূলক, সৃজনশীল এবং সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার পথ সুগম করবে।


নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের সংগঠন, শিক্ষক-অভিভাবকদের মতামত ও প্রস্তাবনা নিয়ে একটি সুষ্ঠু


নীতি তৈরি করা উচিত। এই নীতি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ উন্নয়নে অবদান এবং শিক্ষার পরিবেশ সুরক্ষিত করতে হবে।


শিক্ষা ও রাজনীতির সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেবল জ্ঞানের উৎস নয় বরং সামাজিক সচেতনতা এবং নাগরিক দায়িত্ব বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে, শিক্ষার্থীরা তাদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে জানার ও তা প্রয়োগের সুযোগ হারায়।


শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজে পজিটিভ পরিবর্তন আনার সুযোগ সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র রাজনীতি যদি সমাজের উন্নতি এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বিকাশে অবদান রাখে, তবে তা প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।


ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশ, চর্চার জন্য সঠিক নীতিমালা ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে


সম্মান, সহিংসতার প্রতিরোধ, এবং বৈচিত্র্যময় মতামত প্রকাশের পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে।


গণতন্ত্র ও নেতৃত্ব বিকাশে ছাত্র রাজনীতি একটি অপরিহার্য অংশ। এর মাধ্যমে তারা গণতন্ত্রের মূল ধারণা, নেতৃত্ব দেওয়া, সংঘাত সমাধান এবং প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন দিক শিখতে পারে। এই ধরনের শিক্ষা তাদেরকে ভবিষ্যতে সমাজ ও দেশের নেতা হিসেবে সুষ্ঠু নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে।


বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশ ও চর্চা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দক্ষতা উন্নত করে তুলতে পারে। যা একটি সচেতন, দায়িত্ববান ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে অবদান রাখে। নিষিদ্ধকরণের পরিবর্তে ছাত্র রাজনীতির সঠিক নির্দেশিকা এবং নীতিমালা প্রণয়ন করে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা উচিত। এর মাধ্যমে, শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করতে, সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে এবং নীতি নির্ধারণে অংশ নিতে পারবে- যা স্বাস্থ্যকর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ।


রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগ, সমন্বয় এবং দলগত কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, যা তাদের আগামীর জন্য অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও, এটি তাদেরকে বিভিন্ন মতামতের প্রতি সহনশীল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার ক্ষেত্রে আরো উদার এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।


একটি সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশ তৈরির জন্য, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও সৃজনশীল উপায়ে রাজনৈতিক চর্চা এবং সমাজে অবদান রাখতে পারে, তার জন্য বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠান সেই পথ প্রশস্ত করে তোলে। এভাবে, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ একটি স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়, যা সমাজে সচেতনতা, দায়িত্ববান এবং নেতৃত্বে সক্ষম নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে, আমরা একটি সমৃদ্ধ এবং সহনশীল সমাজ গঠনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি।


এই প্রস্তাবনা ও বিশ্লেষণ এই মতামত প্রদান করে যে, ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা ও বিকাশ শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, সমগ্র সমাজের জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক চর্চা ও কার্যকলাপ যেকোনো সমাজে গণতন্ত্র ও সহনশীলতার ভিত্তি স্থাপন করে। তাই, রাজনীতির নামে যেকোনো ধরনের সহিংসতা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপের প্রতিরোধ করতে হবে, কিন্তু সেটি নিষিদ্ধের মাধ্যমে নয়, বরং সুষ্ঠু নীতিমালা ও গাইডলাইনের মাধ্যমে যা শিক্ষার্থীদের পজিটিভ ও সৃজনশীল অংশগ্রহণে উৎসাহ দেয়।


একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন মত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা শিখতে পারে, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও যুক্তি বিকাশ করতে পারে এবং সমাজে দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে তাদের ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এই সমস্ত কারণে, বুয়েটসহ বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশ ও চর্চা নিশ্চিত করা উচিত, যা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে।


শেষ কথায়, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি একটি বৃহত্তর সমাজের মধ্যে গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে। ছাত্র রাজনীতি যদি সঠিকভাবে গড়ে তোলা হয়, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে সমাজে প্রগতি এবং উন্নতির এক মহান উৎস হতে পারে। তাই, ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা এবং এর ইতিবাচক দিকগুলোকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি নেতিবাচক দিকগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।


লেখক: সুশান্ত দাস গুপ্ত, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বাংলাদেশ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। বর্তমান হেলথ-সেইফটি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন অ্যাডভাইজার, মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স, ইউকে।


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com