‘আমি মায়ের কাছে যাবো’ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক উক্তি
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৮
‘আমি মায়ের কাছে যাবো’ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক উক্তি
মো. হাফিজুল ইসলাম হাফিজ
প্রিন্ট অ-অ+

‘আমি মায়ের কাছে যাবো’ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক উক্তি। যে উক্তি উচ্চারিত হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম কঠিন, ভয়ংকর ও সংকটাপন্ন মুহূর্তে মাত্র দশ বছরের ছোট্ট একটি শিশুর কণ্ঠে। কারণ এই ধরার বুকে শত বিপদ ও কঠিন মুহূর্তে মায়ের কোলই সন্তানের জন্য একমাত্র নিরাপদ স্থান। শুধু মানুষ নয় পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী মাকে যেমন নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে ঠিক প্রতিটি মা সকল বিপদ ও কঠিন মুহূর্ত উপেক্ষা করে, নিজের জীবন বাজি রেখে সন্তানকে রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।


সেদিন ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও ভয়ংকর মুহূর্তে দাড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মায়ের কোলে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু যখন ভয়ে সংশয়ে তার কণ্ঠে এই হৃদয়বিদারক উক্তি উচ্চারিত হয়েছিল- যখন একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মায়ের কোলে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছিল- তখন তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন মৃত।


জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও সংকটাপন্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট শিশুটির কণ্ঠে এই হৃদয়বিদারক উক্তি উচ্চারিত হওয়ার আগেই হায়েনার দল এক এক করে তার সকল আশ্রয়, আবদারের মানুষগুলোকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ছোট্ট শিশুটি তখনও ভাবতে পারেনি যে নরপিশাচ হায়েনার দল সকলের মতো তাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করবে। দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে রাসেল এবং বাড়ির কাজের ছেলে আব্দুর রহমান রমাকে নিচে আনা হয়। চারিদিকে প্রিয়জনদের ক্ষতবিক্ষত লাশ, রক্ত, মাংস, মাথার মগজ ছড়ানো ছিল। এমন ভয়ংকর পরিবেশে শেখ রাসেল আতংকে জড়সড় হয়ে হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ মুহিতুল ইসলামকে বলেছিল, ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো? এরকম বাচ্চা শিশুকে হত্যা করা সম্ভব না; সেই আশায় মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না। ছোট্ট ফুটফুটে চঞ্চল একটা শিশুকে এমনভাবে হত্যা করা যায় সেটা উপস্থিত অনেকেই ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারেনি বলেই বাঁচার আকুতি নিয়ে মায়ের কাছে এবং পরক্ষণেই আল্লার দোহাই দিয়ে জার্মানিতে অবস্থানরত হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়েছিল।


কিন্তু হায়েনার দল তাকে তার মৃত মায়ের কাছে নেওয়ার কথা বলে মা-বাবা সহ সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে উপরে নিয়ে ধীর মস্তিষ্কে নিষ্ঠুরভাবে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এমনভাবে গুলি করে যে তাতে তাঁর মাথার খুলির একাংশ উড়ে যায়। সাথে সাথে পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা হয় সবচেয়ে নৃশংস, নিষ্ঠুরতার এক নির্মম ইতিহাস।


হ্যাঁ, ১৫ আগস্টই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড কেবল পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকেই নয় বরং কারবালার নিষ্ঠুরতাকেও নিঃসন্দেহে হার মানায়। কারণ এই পৃথিবী সৃষ্টির পর যত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে তাতে কোনো নিরীহ ছোট্ট শিশুকে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়নি। নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়নি অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে এবং পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার অপেক্ষায় থাকা গর্ভের কোনো শিশুকে। হত্যা করা হয়নি কোনো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে। ১৫ আগস্ট কেবল একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই নয় বরং একটা পরিবারকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার এক অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। সেদিন একে একে বঙ্গবন্ধু পরিবারের উপস্থিত সকলকেই এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে উপস্থিত সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।


১৫ আগস্টের নৃশংসতা ও নির্মমতার এক হৃদয়বিদারক বর্ণনা পাওয়া যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি কর্তৃক প্রদত্ত সেনানিবাসের স্টেশন মাস্টার বরাবর ১৮ আগস্ট দাখিল করা প্রতিবেদনে। তার প্রতিবেদনে সেদিনের হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা ও নৃশংসতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।


৩২ নম্বর বাড়িটির দেয়ালে, মেঝেতে এবং জানালার কাঁচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়া। গুলির আঘাতে বাড়ির জানালার কাঁচ ও দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নববিবাহিত শেখ জামালের বিয়ের উপহার সামগ্রিক এমন কি পবিত্র কোরআন শরিফ পড়ে ছিলো মেঝেতে। একেবারে কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবারের বাদবাকি সকলকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ তলপেট ও বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করে ফেলে রেখেছিল হায়েনার দল। সেদিনের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই ছিল নির্মম, নৃশংস এবং এই নৃশংসতা পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে ছাড়িয়ে সৃষ্টি করে এক জঘন্য ইতিহাস।


যে ব্যক্তি বাঙালি জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি তথা স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এই জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মু্ক্তির জন্য যিনি স্ত্রী এবং সন্তানদের সাথে জীবনের যে সুখসময় কাটানোর কথা তা ত্যাগ করে দীর্ঘ ৪,৬৮২ দিন হাসিমুখে কারাবরণ করেছেন। সেই মহান ব্যক্তিকে সপরিবার নৃশংস ও নির্মমভাবে হত্যা করে বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালি জাতি চরমভাবে বেইমান ও অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে।


অকৃতজ্ঞ কিছু কুচক্রী সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নয় পৃথিবীর মানচিত্রে সদ্য ভূমিষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের পুরো ৫৬ হাজার বর্গমাইল গুলিতে ঝাঁঝরা করেছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা কেবল সপরিবার হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি বরং তাঁর সকল অবদান, মহান ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাসকে ধূলিসাৎ করার লক্ষ্যে যা যা করা প্রয়োজন পরবর্তীতে তা করার জন্য সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছিল।


স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদানকে খাটো করা এবং ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে ৭ কোটি বাঙালি উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই ভাষণ প্রচার বন্ধ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগারে বহু যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় বন্দি ছিল। ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট দালাল আইন বাতিল করে সে সকল যুদ্ধাপরাধীদের রাতারাতি মুক্ত করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়া হয়।


তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর আমলে নিষিদ্ধ মদ, জুয়া, হাউজি ও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা পুনরায় চালু করা হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারিক কাজ বন্ধ করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। খুনিদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। এগুলো সবকিছুই করা হয় একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সকল অবদানকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। কিন্তু তারা জানত না যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শারীরিকভাবে হত্যা করা গেলেও তাঁর আদর্শ আরো অধিক শক্তিশালী হয়ে যুগের পর যুগ টিকে থাকবে আবহমান বাংলার রূপ বৈচিত্রে। টিকে থাকবে বাংলার বুকে বহমান শত নদীর উর্মিমালা ও মোহনায়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবে এদেশের অবারিত সবুজ বনানী ও শস্য-শ্যামল ফসলের মাঠে। কারণ বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্তা।


লেখক : শিক্ষার্থী, বিএসএস (অনার্স), এমএসএস (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ঢাবি।


বিবার্তা/এসবি/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)

১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,

বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com