সাহিত্য হাসপাতালের চিত্র : বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ১৬:১৬
সাহিত্য হাসপাতালের চিত্র : বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি
রাশেদ হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+

সংস্কৃতির একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিক ‘সাহিত্য’ যার মধ্যে দিয়ে সমাজের একটি বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তেমনি বাংলাদেশের হাসপাতাল ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবিও সাহিত্যমনা লেখকরা বিভিন্ন সময়ে তাদের লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যদিও বাংলাদেশের হাসপাতাল নিয়ে উপন্যাস, ছোট গল্প, গবেষণামূলক গ্রন্থ খুব যৎসামান্যই রয়েছে। বর্তমান এই প্রবন্ধটি হাসান আজিজুল হাকিমের ‘পাতালে হাসপাতালে’ ছোটগল্পের বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্যে হাসপাতালের যে চিত্র তা তুলে ধরার এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।


‘পাতালে হাসপাতালে’ বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, গল্পকার হাসান আজিজুল হাকিমের একটি ছোটগল্প যার মাধ্যমে গল্পকার হাসপাতাল ব্যবস্থার কিছু দিক তুলে ধরেন। ১৯৮১ সালে লেখা এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা বর্তমানেও দৃশ্যমান। গল্পকার হাসান আজিজুল হাকিম অত্যন্ত সুনিপুনভাবে কবিরাজ, হুজুর, বৈদ্য নির্ভর বাংলার চিকিৎসা সংস্কৃতি, হাসপাতাল ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত জনবলের অভাব, ডাক্তার-নার্সদের দুর্ব্যবহার, এবং অসুস্থতায় গরিব দুঃখীদের অসহায়ত্বের দিকটি তুলে ধরেন। গল্পে জমিরুদ্দিন নামে এক কৃষক বাবলার কাঁটা বিঁধলে প্রথমে নাপিতের কাছে এবং পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে ফোলা পা নিয়ে যখন হাসপাতালে যায় তখন ডাক্তার মনোযোগ সহকারে দেখেন না এবং হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় তাকে প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি করতেই অপারগতা জানায়। অবশেষে ভর্তি হয়ে জমিরুদ্দিন কয়েকদিন হাসপাতালেই পড়ে থাকে বিনা চিকিৎসায়। গল্পের আরেক চরিত্র রাশেদ যখন প্রফেসরকে জমিরুদ্দিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তখন প্রফেসর বলেন আজকেই অপারেশন না করতে পারলে জমিরুদ্দিনকে বাচানো যাবে না, পাশাপাশি এই মুহূর্তেই অপারেশন করার অপারগতাও জানান তিনি। গল্পের শেষ মুহূর্তে দেখা যায় জমিরুদ্দিনের স্ত্রী তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই এবং এভাবেই শেষ হয়েও শেষ হয় না এই গল্পটি।


উল্লেখিত গল্পটিতে প্রথমত বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি দিক অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। গল্পে দেখা যায় ‘জমিরুদ্দিন’ নামের এক কৃষকের পায়ে বাবলার কাঁটা বিধঁলে সে নাপিতের কাছে যায় কাঁটাটি তুলে ফেলার জন্য যা পরবর্তীতে তার জন্য মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসে। অসুস্থ হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে হুজুর, বৈদ্য, ওঝা এই শ্রেণিভুক্ত মানুষদের থেকে চিকিৎসা নেওয়া বাংলাদেশের মানুষদের একটি চিরাচরিত প্রথা। মানুষ অসুস্থ হলেই প্রথমে ছুটে যায় হুজুরের কাছে পানি পড়া কিংবা ঝাঁড় ফুঁক নেওয়ার জন্য। এই ধরণের চিকিৎসা পথ্যকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘Complementary and Alternative Medicine'. তবে অলটারনেটিভ চিকিৎসা গ্রহণ করার সাথে আর্থিক দিকটার একটা সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার পিরামিডের নিম্নে অবস্থানকারীরাই সবচেয়ে বেশি অলটারনেটিভ চিকিংসায় বিশ্বাস করে৷ গল্পেও গরিব কৃষক জমিরুদ্দিন নাপিতের কাছে যান। পূর্বে বঙ্গদেশে নাপিতরাও অনেক পোড়া কাঁটার কাজ করতো, যার একটি আংশিক প্রতিচ্ছবি এই জমিরুদ্দিনের কাঁটা তোলার কাজ।


হাসান আজিজুল হাকিম এই গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের হাসপাতাল ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত জনবল না থাকার দিকটাও অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। গল্পে প্রফেসর, রাশেদকে (গল্পের আরেক চরিত্র) যখন বলে, “ এখন হাসপাতালে সার্জারিতে একমাত্র আমিই প্রফেসর আছি” তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে জর্জরিত উল্লেখিত হাসপাতালটি জোড়া তালি দিয়ে চলছে। আজও খবরের পাতায় এরকম অসংখ্য সংবাদ দেখতে পাওয়া যায় যেখানে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে হাসপাতালের সাধারণ কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। একটা সংবাদে দেখতে পাওয়া যায় চরফ্যাশন উপজেলা সদর হাসপাতালকে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করলেও জনবল রয়েছে ৫০ শয্যার। একইভাবে আরেকটা সংবাদে দেখা যায়, নড়াইল সদর হাসপাতালে রয়েছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর অভাব এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২০০ শয্যা থাকলেও জনবল আছে ৫০০ শয্যার। পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে যে সমস্যা তৈরি হয় তা হলো যার যে কাজ তা করতে না পারা। লেখক শাহাদুজ্জামান তাঁর ‘একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙা হাড়, নামক গবেষণা মূলক গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে নার্সদের তাদের বরাদ্দ কাজ না করে প্রশাসনিক কাজ করতে হয়। তাইতো তিনি বাংলাদেশের নার্সদের প্রদীপবিহীন নাইটিংগেল বলে মন্তব্য করেন। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু বেসরকারি হাসপাতালেও উন্নতমানের মেশিন থাকলেও তা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। শহরের সুবিধা ছেড়ে কেউই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে চাই না। এই স্বাভাবিক সময়ের পাশাপাশি যখন Endemic (ডেঙ্গুর মৌসুম) কিংবা Pandemic (করোনা ভাইরাস কালীন সময়) তৈরি হয়, তখন হাসপাতালের অবস্থা হয়ে পড়ে আরো করুণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে উঠে দুষ্কর।


হাসান আজিজুল হাকিম গল্পটির মাধ্যমে আরেকটি বিষয় তুলে ধরেছেন তা হলো ডাক্তার-নার্স-রোগীর সম্পর্ক। ডাক্তাররা এবং নার্সরা কীভাবে রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন তা গল্পটিতে জমিরুদ্দিন এর সহিত ব্যবহার পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়। ডাক্তারদের ব্যবহার এবং নার্সদের কর্মকান্ডে রোগী হয়ে উঠেন নীরব দর্শক। রোগীর নৈর্ব্যাক্তিকরণে ডাক্তার এবং নার্সদের দুর্ব্যবহার দায়ী। ডাক্তারদের কিংবা নার্সদের এই কঠোর নীতি হাসপাতাল ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনি সমাজবিজ্ঞানী মার্টনের মতে, রোগীর নৈর্ব্যক্তিকরণ হলো হাসপাতাল ব্যবস্থার একটি অপক্রিয়া (dysfunction). সমাজবিজ্ঞানী মার্টন তিন ধরণের ফাংশনের কথা উল্লেখ করেন। একটি হলো ম্যানিফেস্ট ফাংশন। হাসপাতালের ম্যানিফেস্ট ফাংশন হলো রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া। মার্টনের দ্বিতীয় ফাংশন হলো লেটেন্ট ফাংশন। রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী রোগীকে দেখতে আসে। এতে রোগীর সাথে প্রতিবেশীর, আত্মীয় স্বজনদের সাথে, নিজ পরিবারের সাথে বন্ধন আরো দৃঢ় হয় । এই সামাজিক সংহতি তৈরিই হলো হাসপাতালের লেটেন্ট ফাংশন। অন্যদিকে মার্টনের তৃতীয় ফাংশন হলো ডিসফাংশন। হাসপাতাল ব্যবস্থার কঠোর নিয়ম নীতির ফলশ্রুতিতে রোগীর ভূমিকা যে নৈর্ব্যক্তিকরণ হয়ে যায় তাই হলো হাসপাতালের ডিসফাংশন। এতে ব্যক্তির নিজস্বতা বলতে কিছুই থাকে না। এ ব্যবস্থায় রোগীর অসহায়ত্বই ফুটে উঠে। ব্যক্তিকে নাচতে হয় হাসপাতাল ব্যবস্থার ইশারায়। গল্পকার এই বিষয়টি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেন জমিরুদ্দিন চরিত্রের মাধ্যমে।


হাসপাতাল শব্দটি বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতো। যেমন এক সময় হাসপাতাল বলতে বুঝাতো মরণকেন্দ্র (Death house) যেখানে গরিবরা মারা যাওয়ার জন্য আসতো। উপরিউল্লিখিত গল্পেও জমিরুদ্দিন যখন রাশেদকে বলছিল, “আমি এখানে অনেকদিন রয়েছি। বাঁচবো বলে নয়, মরবার জন্য। মরণ হচ্ছে না। এতবড় হাসপাতাল আমার মরার ব্যবস্থা করতে পারছে না”, তখন স্বভাবতই মনে হয় ‘Hospital is a place where the poor went to die' (ককারহাম, ২০১৬)।


‘পাতালে হাসপাতালে' গল্পটি সমস্যাগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি তা সমাধানেরও ইঙ্গিত বহন করে। অনেক সময় গ্রামের বৈদ্য, ওঝা দিয়ে কাজ সমাধান হলেও মাঝে মাঝে তা আমাদের সমস্যা না কমিয়ে বৃদ্ধি করতে পারে। তাই সবার উচিত সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহন করা। দ্বিতীয়ত হাসপাতাল গুলোর শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি দক্ষ জনবল গড়ে তোলাও অতীব জরুরী। দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে না পারলে যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থায় মরিচা ধরবে, তেমনি স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনেও অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে। তৃতীয়ত সঠিক চিকিৎসাসেবা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডাক্তার এবং নার্সদের এবং রোগীর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। রোগীদের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এককথায় হাসপাতাল যেন হয়ে উঠে সত্যিকারের Remedy House সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।


লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com