আমি শুধু রইনু বাকি
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ০৮:২৩
আমি শুধু রইনু বাকি
জয়ন্তী রায়
প্রিন্ট অ-অ+

কয়েকদিন থেকেই পঙ্কজদার (পঙ্কজ ভট্টাচার্য) জন্য মনটা খারাপ হয়ে ছিল। তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। যেদিন হাসপাতালে নেওয়া হলো, সেদিন থেকেই মনটায় কেন যেন কু গাইছিল। এবার কি তিনি সুস্থ হয়ে আবার ঘরে ফিরতে পারবেন? নাকি শুনতে হবে কোনো দুঃসংবাদ? শেষেরটাই সত্য হলো। ২৪ এপ্রিল রাত ১২.২০ মিনিটে আমার মতো আরও অসংখ্যজনকে কাঁদিয়ে পঙ্কজদা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর বয়স হয়েছিল। বিশেষ করে তিন বছর আগে স্ত্রী রাখীদাশ পুরকায়স্তের মৃত্যুর পর পঙ্কজদা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। ৮৪ বছরে কারো জীবনাবসান হলে তাকে অকালে চলে যাওয়া বলে না। তবুও পঙ্কজদার এই চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। 


পঙ্কজদা রাজনীতিবিদ ছিলেন, ছিলেন দেশব্রতী, মানবপ্রেমী। তার অনেক অনুসারী ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন অনেকের নির্ভরতার স্থান, অভিভাবকের মতো। সমাজটা বদলাতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন একটি মানবিক সমাজ। লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলে কিন্তু তিনি লক্ষ্যচ্যুত হননি শেষদিন পর্যন্ত। 


আমার কাছে তিনি সত্যি ছিলেন বড় ভাইয়ের মতো, আমার স্বামী প্রয়াত অজয় রায়ের সঙ্গে ছিল যেন তার আত্মার আত্মীয়তা। পঙ্কজদা আর অজয় রায়ের পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি আমি খুব কাছে থেকেই দেখেছি। কত বিষয়ে যে তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলতেন! রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে তারা হয়ে উঠেছিলেন পারিবারিক বন্ধুও। আমাদের এক পুত্র ও দুই কন্যার পঙ্কজ মামা যে তাদের কাছে কত আপন ছিল তা বলে বোঝানোর মতো ভাষার জোর আমার নেই। আমার মেয়েরা ফুচকা খেতে পছন্দ করে এটা পঙ্কজদা জানতেন। ওরা দেশে এলে ঠিকই পঙ্কজদা ওদের ফুচকা খাওয়াতে ভুলতেন না। 


অজয় রায় মারা যান ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর। তিনি যখন হাসপাতালে, তখন মুখে কথা বলতে না পারলেও কাগজে লিখেও পঙ্কজদার সঙ্গে কথা বলতেন। পঙ্কজদাকে তিনি তখন ঢাকার বাইরে যেতে মানা করেছিলেন হয়তো তখন অজয় রায় অন্তরাত্মার ডাক শুনেছিলেন। তাই দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও পারিবারিক সুহৃদ পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে ঢাকা ছাড়তে বারণ করেছিলেন, শেষ সময়েও কাছে পাওয়ার আশায়। পঙ্কজদা তার শুভাকাঙ্ক্ষী অজয় রায়ের কথা রেখেছিলেন, শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পরও শেষকৃত্যের জন্য যখন কিশোরগঞ্জের নিজ এলাকায় অজয় রায়কে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। 


পঙ্কজদা শুধু ভালো, সৎ, দরদি রাজনৈতিক নেতা ছিলেন তা-ই নয়। তিনি আরও অনেক কিছুতেই ভালো ছিলেন। ভালো লিখতেন, কণ্ঠস্বর ছিল ভালো- আবৃত্তি করলেও সুখ্যাতি পেতেন নিঃসন্দেহে। গানের গলাও খারাপ ছিল না। রান্না করতে পারতেন পাকা রাঁধুনির মতো। তার হাতের রান্না যারা খেয়েছেন তারা সবাই প্রশংসা না করে পারেননি। পঙ্কজদার মতো অমন সাদাসিধা, উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষ আমাদের সমাজে এখন খুব বেশি নেই। তিনি সব সময় দুঃখকষ্ট আড়াল করে হাসিখুশি থাকতেন। কথাবার্তায় থাকত রসিকতা। এত কথা হয়েছে, এত সময় আমরা কাছাকাছি কাটিয়েছি কিন্তু কখনো কোনো বিষাদের কথা, দুঃখের কথা বলেননি। 


অজয় রায়ের সঙ্গে তার অনেক বিষয়েই মিল ছিল বলেই বুঝি দুই জন হরিহরাত্মা হতে পেরেছিলেন। দুই জনই আত্মীয় পরিজন পরিবার ছেড়েছেন, কিন্তু দেশ ছাড়েননি। অজয় রায়ের বাবা ছিলেন বহু ভাষাবিদ একজন পণ্ডিত মানুষ। বানারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন অজয় রায়ের বাবা। পঙ্কজদার বাবাও ছিলেন একজন ভালো শিক্ষাবিদ। পঙ্কজদা তার স্মৃতিকথা ‘আমার সেই সব দিন' বইয়ে নিজের পিতা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘আমার বাবার নাম প্রফুল্ল ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন এমএসসি বিটি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। পিতার আদেশে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য তাঁর প্রিয় শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পায়ের কাছে স্বর্ণপদকটি রেখে আশীর্বাদ কামনা করেন। প্রফুল্লচন্দ্র তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তুমি কী হতে চাও?' উত্তরে বাবা বলেছিলেন, বন্ধুরা বলছে আমাকে আইসিএস দেওয়ার জন্য। প্রফুল্লচন্দ্র নিজের পায়ের খড়ম তুলে তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ব্রিটিশের পা-চাটা গোলাম হওয়ার জন্য তো আমি তোমাকে শিক্ষা দিইনি । শিক্ষকতা করে তুমি হাজার হাজার ছাত্রকে শিক্ষিত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোল। এ জন্য তুমি বিটি পরীক্ষা দাও।' বাবা তাঁর কথা শুনে শিক্ষকের কষ্টের জীবনই বেছে নিলেন। বাবার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ডিপিআই ফেরদৌস খান, পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম (প্রবেশিকা পরীক্ষায় যিনি প্রথম হয়েছিলেন), সাবেক রাষ্ট্রদূত আতাউর রহমান কায়সার প্রমুখ।‘ 


এই পিতার সন্তান পঙ্কজ ভট্টাচার্য দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন দেশকর্মী হওয়ার পথ। অন্যায়, বৈষম্য, অনিয়মের বিরোধিতা করা ছিল তার আজীবনের সাধনা। পঙ্কজ ভট্টাচার্য নিজেই নিজের সম্পর্কে লিখেছেন- ‘আমার জীবনের সেরা সময়টুকু দিয়েছি আমি ছাত্র ইউনিয়নের নবজন্ম ঘটানোর কাজে। নিজের মেধা, শ্রম, ঘাম—সবকিছু নিয়ে এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। দিনে-রাতে নিজের বলে আলাদা কোনো সময় ছিল না। সাংগঠনিক কাজে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে সেখানে ছাত্রাবাসে থাকতাম। ছাত্রদের সঙ্গে একান্ত আপনজনের মতো মিশতাম । তাদের ভর্তি থেকে শুরু করে বই সংগ্রহ, নোট সংগ্রহ, আবাসন সমস্যার সমাধান— সবকিছুই পরিকল্পিতভাবে করতাম। একঝাক নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীকে নিয়ে ঢাকা শহরসহ সারা দেশে বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে আমরা সেদিন ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাতলে বিশাল এক যুবশক্তির সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলাম।‘


ছাত্র জীবনেই তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। হতে হয়েছে ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। কারাগারে ১৯ দিন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকটসান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে স্নেহ করতেন। রাজনৈতিক বিষয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি খোলামেলা অনেক আলোচনা করেছেন। পঙ্কজদা ১৯ দিন পর জেল থেকে মুক্তি পেলে জেলগেটে বেলি ফুলের মালা গলায় পরিয়ে আলিঙ্গন করে বিদায় দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে সামরিক বাহিনীর ভেতরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এই খবরটি একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের কাছে শুনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগেই পঙ্কজ ভট্টাচার্য গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে এসেছিলেন। আহা, বঙ্গবন্ধু যদি ওই খবরটি বিশ্বাস করে নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতেন, তাহলে হয়তো ১৫ আগস্টের চরম ট্রাজেডি না-ও ঘটতে পারতো! 


অজয় রায়ের পিতার মৃত্যু পর তিনি বারানসি থেকে কিশোরগঞ্জ ফিরে এসেছিলেন। এমন কি দেশ ভাগের পরও আত্মীয়স্বজন সবাই দেশত্যাগ করলেও অজয় রায় থেকে গেলেন দেশের টানে, দেশকে ভালোবেসে। পঙ্কজদাও কিন্তু তাই করেছেন। তার বাবা-মা, ভাইবোনেরা গত শতকের ষাটের দশকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেও পঙ্কজদা থেকে যান দেশেই। বাবা-মা দেশ ছাড়ার সময় পঙ্কজ ভট্টাচার্য জেলে ছিলেন। স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘এক মাস পর জেলার সাহেব আমাকে জানালেন দু-তিন দিনের মধ্যে আমাকে কুমিল্লা জেলে বদলি করা হবে। আরও বললেন, আমি চাইলে আমার পরিবারবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেতে পারি। যথারীতি আমি রাজি হলাম। পরদিন বাবা মা-বোনদের নিয়ে দেখা করতে এলেন। স্বদেশের মাটিতে সেটাই ছিল তাঁদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। যত না কথাবার্তা, তার চেয়ে বেশি কান্নাকাটির মধ্যে মাকে সাক্ষী রেখে বাবা আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, 'তুই যদি আমাদের দায়িত্ব নিস, তাহলে আরও বছর দুয়েক এই অসহনীয় অবস্থার মধ্যে কাটাতে চেষ্টা করব।' জবাবে বাবা-মা-বোনদের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলেছিলাম, 'তোমাদের তো আরও চারটি ছেলে আছে, পঞ্চম ছেলেটিকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দাও। অন্য ভাইদের বলো তোমাদের দেখতে। আমাকে আশীর্বাদ করো।'


দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে পঙ্কজদা দেশান্তরি হননি। ক্ষমতার রাজনীতি তিনি করেননি। বড় দলে গিয়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবও তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু মানুষের জন্য সংগ্রাম থেকে তিনি পিছু হটেননি। যখন যেখানে মানুষের অধিকার হরণের চেষ্টা হয়েছে, যেখানেই মানুষের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, সেখানেই পঙ্কজদা ছুটে গেছেন। বয়স কিংবা শারীরিক অসুস্থতা তাকে মানুষের ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। 


পঙ্কজদার জন্ম হয়েছিল ২২ শ্রাবণ। তাঁর জন্মের সামান্য ক’বছর পরই ২২ শ্রাবণ মৃত্যুবরণ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার কি আশ্চর্য, বৈশাখ মাসে পঙ্কজদা বিদায় নিলেন পঙ্কজদা। বৈশাখের ২৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। না, রবীন্দ্রনাথের মতো বড় প্রতিভার অধিকারী না হলেও পঙ্কজদাও কিন্তু মানুষের কম ভালবাসা পাননি। তার মরদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হলে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোতে ফুলের ঘাটতি আমি নিজেই তোড়া কিনতে গিয়ে দেখেছি। 


পঙ্কজদা মাছের মুড়িঘণ্ট খেতে পছন্দ করতেন। কখনো মুড়িঘণ্ট রান্না করলে পঙ্কজদার কথা মনে পড়বে। একে একে স্বজন-প্রিয়জনদের বিদায় দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ভাবছি ‘আমি শুধু রইনু বাকি'...। পঙ্কজদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।


আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। 


বিবার্তা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com