
১৯৫৪ সালের ঘটনা, মাত্র ১৪ বছর বয়সের এক কিশোরী— হোসেনপুর থেকে কিশোরগঞ্জের গুজাদিয়ার সোলায়মান মাস্টারের ছেলে আব্দুল ওয়াহেদ-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, সূচনা করেন নতুন জীবনের।
হাজী দরবারী— যে তাঁর ভাতিজার বিয়ের সকল কাজ সমাধান করেছিলেন। কারণ হাজী দরবারী ২য় বিবাহ করেছিলেন যার কথা বলছি সেই নারীর অর্থাৎ আমার আম্মার আপন বিধবা চাচীকে। সে সুবাদে হাজী দরবারীর নিয়মিত যাতায়ত ছিল হোসেনপুর (আড়াই বাড়ী) আমার নানার বাড়িতে।
সেখানেই হাজী দরবারী তাঁর ভাতিজা আব্দুল ওয়াহেদ-এর জন্য পছন্দ করেন সুন্দরী কিশোরী রহিমা আক্তারকে। তাঁর একান্ত ইচ্ছা আর পছন্দে হোসেনপুরের ‘মোল্লা বাড়ির’ মেয়েটি হয়ে গেল গুজাদিয়ার বৈরাটীর গৃহবধূ। জনশ্রুতি আছে, সেই গৃহবধূটি— আমার আম্মা তখনকার আমলে আমার দাদার বৈরাটী পরিবারের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা ছিলেন।
আরো উল্লেখ করা যায়, হোসেনপুর থেকে তিন মহিলা আমাদের বৈরাটী পরিবারে বধূ হয়ে এসেছিলেন। তারা হলেন দাদু, বড় চাচী (ড. ওসমান গনির স্ত্রী) আর আমার আম্মা। তারা আবার পরস্পর আত্মীয়া ছিলেন।
যাই হোক, মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বল্প শিক্ষিত একজন গৃহিনী আমার মা। ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া আমার মায়ের কাছেই আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু। চাকরি-ব্যাবসা নিয়ে আব্বা সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মহাব্যস্ত। আম্মাই যে আমাদের বন্ধু, আমাদের গুরু!
সকাল সন্ধ্যায় পড়াতে বসা, স্কুলের পড়া তৈরি করা সবই ছিল একজনের দায়িত্ব ! গৃহশিক্ষক রাখা তো ছিল চিন্তার বাহিরে। আম্মাই ছিল আমাদের গৃহশিক্ষিকা। এভাবেই অতিবাহিত হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি— কঠোর পরিশ্রম, তাঁর মেধা আর আদর সোহাগ, শাসন দিয়ে আমাদের আট ভাই বোনকে আগলে রেখেছেন—
তিনি আমার ‘মা’ এক মহিয়সী নারী!
রাজাবাজারের ৪ বেডরুমের বাসায় ৮ ভাইবোন গাদাগাদি করে থাকতাম। পড়ালেখা করতাম টেবিল চেয়ার শেয়ার করে। বৃহৎ পরিবারে কেউ দিচ্ছে প্রাইমারি বৃত্তি , কেউবা জুনিয়ার বৃত্তি পরীক্ষা, কারো বা এস.এস.সি পরীক্ষা! এভাবে সকলের পরীক্ষার প্রস্তুতি, পরীক্ষার্থীকে একটু আলাদা যত্ন— সকল দায়িত্ব যে একজনেরই কাঁধে!
সে যে আমার ‘ মা’— এক মহিয়সী নারী।
৪ বেডরুমের সেই বাড়িতে আমরা ৮ ভাই বোন ছাড়াও সারা বৎসর উল্লেখযোগ্যভাবে যা ছিল তা ‘মেহমানদারী’ । গ্রাম থেকে আত্মীয়রা আসত ঢাকা শহর দেখতে আর চিকিৎসা করাতে! এই ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের নৈমিত্তিক রোজনামচা বা রুটিন!
মেহমানদের জন্য বিছানা ছেড়ে আমাদের জায়গা হত ফ্লোরে। টেবিলে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি, পাশের রুমে রোগীর গোঙানি অথবা কাশির প্রচণ্ড শব্দ, শিক্ষার্থী আর রোগীর সেবা একসাথেই করে যাচ্ছেন একজন!
তিনি আমার ‘মা’— এক মহিয়সী নারী।
৮ ছেলেমেয়েকে শহরের নাম করা সব স্কুল-কলেজে (হলিক্রস কলেজ, নটরডেম কলেজ) পড়ালেখা করানো, শিক্ষিত করা সেইসাথে বাড়ির আত্মীয়দের মেহমানদারি, রোগীর সেবা করতে করতেই চলে যায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি। আট ছেলেমেয়েকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতে নিয়ে যেতেই চলে যায় তাঁর সময়।
কক্সবাজার বেড়ানোর আর সময় হয়নি আমার আম্মার, সেই মহিয়সী নারীর—
আমার স্বল্পশিক্ষিতা গর্ভধারিনী মহিয়সী মাকে ‘রত্নাগর্ভা’ বলে ডাকতে গর্ববোধ করি আমি।
হে আল্লাহ, হে রব সারাটা জীবন যে মহিয়সী নারী শুধু সকলকে ‘সেবাদান আর শিক্ষাদান' করেই গেল, তাঁকে তুমি জান্নাতুল ফেরদৌস দান করো, আমীন।
লেখক : প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম বকুল।
বিবার্তা/এসবি/জবা
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]