রোজনামচায় নারীদিবস
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৩, ১৭:৪৮
রোজনামচায় নারীদিবস
সঙ্গীতা ইয়াসমিন
প্রিন্ট অ-অ+

নারীদিবসের প্রাক্কালে এই রোজনামচা লিখতে এসেই মনে হচ্ছে সত্যিই কি আমাদের সাথে বিশ্বায়িত নারী দিবসের থিম সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশের নির্ধারিত থিম কি নারীর অবস্থা, অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারবে? আজ আটই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস।



জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ২০২৩ এর  আন্তর্জাতিক নারীদিবসের থিম  “DigitALL: Innovation and technology for gender equality”. এই দিবসকে ঘিরে বিশ্বব্যাপি রয়েছে নানা কল্পনা জল্পনা আগ্রহ ও উদ্দীপনা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নেতা হিসেবে জাতিসংঘ নারীদিবসের জন্য প্রতিবছর যে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে সিডও সনদে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য রাষ্ট্রসকল সেই প্রতিপাদ্যকে মাথায় রেখেই নিজস্ব থিম নির্ধারণ করে থাকে। বাংলাদেশও তার নিজস্ব প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে -“প্রযুক্তির উদ্ভাবন করবে লিঙ্গ বৈষম্য নিরসন”। 



এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রতিফলন হয়েছে কি এই থিমে? প্রকৃতপ্রস্তাবে নারী দিবস উদযাপন মানে বেগুনী পোশাক পরে সেজেগুজে নারী অধিকার বিষয়ক প্রচার প্রচারণা সভা সমিতি সেমিনার সিম্পুজিয়াম আয়োজন নয়। এর মূল উদ্দেশ্য সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকা অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে উদ্যোগ গ্রহণ করা। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতা আনয়নের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো যেতেই পারে। তবে তার আগে আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত নয় কি কেমন আছেন বাংলাদেশের মেয়েরা? কেমন ছিল তাঁদের ২০২২ সাল? 


এবারে একটু চোখ বুলিয়ে নিই সালতামামিতে- ২০২২ এ ও বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা ও অন্যান্য নির্যাতনের হার বেড়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাইট হাউসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬০ জন নারী। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একইসময়ে সারা দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী। শুধু যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৭৫ জন। যৌতুক না পেয়ে আবার এদের ১৫৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৫৫ জন।



আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) ৯টি পত্রিকা ও কিছু নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন করেছে যেখানে দেখা যায়, ২০২২ সালে ৩ হাজার ১৮৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে যার ৬৪ শতাংশই ধর্ষণের খবর। 



একইসঙ্গে পাঁচ বছর আগের তুলনায় গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মাসে গড়ে ৩৫০টি মামলা বেশি হয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণ মামলা যথারীতি সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে আছে। 


বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) জেন্ডার অসমতাবিষয়ক ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২’-এ বলা হয়েছে, ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম।


নারী নির্যাতন বিষয়ক সকল সুত্রের পরিসংখ্যানে ঘেঁটে যে চিত্র পাওয়া যায় তা চরম উৎকণ্ঠার এবং ভয়াবহ অবস্থার নির্দেশ করে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশুর নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করেছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচার ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করেছে। নির্যাতিতাকে সহায়তা দেবার জন্য রয়েছে ২৪ ঘন্টার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ও হটলাইন ১০৯। আপাতদৃষ্টিতে এতোসব মহাযজ্ঞের পরেও আজকের বাংলাদেশে নারীদের এই অবস্থার পেছনে কে দায়ী প্রশ্ন আসাটা অবান্তর নয় মোটেই।


উপরন্তু এ বছরে নারীদিবসের এই থিমের সাথে সংহতি তো বাংলাদেশ সরকার আগেই করে রেখেছেন সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। আর সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশে সেবাপ্রদানে প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগ সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে অনেক সুফল বয়ে এনেছে যা ইতিবাচকভাবেই দৃশ্যমান। 


প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিইউ) এর দেয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভুয়া আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেলিং, মোবাইল ফোনে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ করেছেন ৮ হাজার ৭১৫ জন নারী। ২০২২ এর জানুয়ারি থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারীর একান্ত মুহূর্তের ভিডিও ফাঁসের অভিযোগে রাজধানীতে ১১২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এসব ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের পাশাপাশি পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনেও মামলা হয়েছে। (প্রথম আলো- সম্পাদকীয়-ডিসেম্বর ২৮, ২০২২)। এই তথ্য থেকে এটা প্রমাণিত যে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে নতুন পদ্ধতিতে নারী নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আমরা একে প্রযুক্তির সুফল না কি কুফল বলব সেটাই এখন আলোচ্য বিষয়। 


একথা অনস্বীকার্য যে একবিংশ শতাব্দীর আজকের পৃথিবীর রেসের ঘোড়াটি ছুটছে ‘এজ অব টেকনোলজি’র পিঠে সওয়ার হয়ে। সুতরাং বিশ্বব্যাপি উন্নয়নের যেকোনো ধারায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন তথা উদ্ভাবনে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। জাতিসঙ্ঘের মতে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উদ্ভাবন, পরিবর্তন এবং প্রশিক্ষণই কেবল পারে লিঙ্গবৈষম্য দূর করে সমতা আনয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে। উল্লেখ্য, প্রযুক্তি বাজারের সর্বাধুনিক পণ্য বহুল আলোচিত এআই আমাদের শ্রমবাজারে অদক্ষ কিংবা স্বল্প দক্ষ মানব শ্রমের ওপর যতই খড়গ ধরুক বিশ্বব্যাপি বাজার নিয়ন্ত্রক নেতৃবৃন্দ আমাদের মগজ ধোলাই করে এআইকেই সর্বেস্বর্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেই। ফলত, আমাদের মত অধিক জনসংখ্যার দেশের ভবিষ্যত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শ্রমবাজারে টিকে থাকার লড়াইটা শুরু করতে হবে এখনই। 


একইসাথে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরিতে পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাকারিকুলাম, সমাজ ও সমাজ মানসের যেসকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার (মনস্তত্ত্ব ও মানসিকতা) পরিবর্তন প্রয়োজন সেসকল ক্ষেত্র এখনও রয়ে গেছে দৃষ্টির অগোচরে। আর সেকারণেই নয়া প্রযুক্তির বাজারেও নারীর সম্ভ্রম ও শরীর হয়েছে পণ্য, যার প্রচারণার টুল হয়েছে সাইবার সহিংসতা, আবারও নারীরা জিম্মি প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে।


কেননা কেবল কিছু নীতিগত পরিবর্তন কাগজবন্দী করে সত্যিকারের পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব হলে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আজতক গৃহিত সরকারী অনেক উদ্যোগই সফল হতে পারত। মূলত নারীকে অধস্তন ভাবার যে সংস্কৃতি, মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে না পারার যে শতবছরের প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ তা-ই পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনি কাঠামোয় লিঙ্গবৈষম্য তৈরি করেছে একথা বললে ভুল হয় না। 



দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচার ট্রাইব্যুনালে ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও মামলার তদন্তে মেডিকেল সনদ, ডিএনএ প্রতিবেদন (ধর্ষণের মামলায় আবশ্যক) পেতে দেরি হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর চিকিৎসক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মামলার বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেতে বছরের পর বছর চলে যায়। মোদ্দাকথা দীর্ঘসূত্রী বিচারপ্রক্রিয়া, রায়ের ক্ষেত্রে বিবাদীর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব এবং সাজাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তাও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করে। 



এছাড়াও নারীর প্রতি সহিংসতায় ধর্ম ও ধর্মীয় কুসংস্কার সরাসরি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউব ব্যবহার করে ধর্মীয় রেফারেন্স অনুযায়ী চলছে নারীর প্রতি ভয়ানক বিষোদগার; নারীর মবিলিটি, শিক্ষা এবং জীবনযাপন নিয়ে যেসকল বয়ান ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া হয় সেগুলোই নারী ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় এজাতীয় উস্কানীদাতারা কখনোই ফিল্টারে আসেন না। 



যে সমাজ এখনও প্রতিনিয়ত প্রতি পদে পদে নারীর ওপর নজরদারী করে (নিজের ঘর ছাড়াও) নারী কী পোশাক পরবে, কার সাথে কখন কোথায় যাবে কেন যাবে, এখনও যৌতুকের দায়ে যেখানে নারী নির্যাতনের শিকার হয়, এখনও যে সমাজে ধর্ষণ সকল নির্যাতনের উচ্চে অবস্থান করে, যে সমাজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এ আই নিয়ে ভাবলেও ‘ভিক্টিম ব্লেমিং ও শেমিং’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি সেই সমাজ কি আদৌ প্রযুক্তির ইতিবাচক ফলাফল গ্রহণ করতে মানসিকভাবে সক্ষম? যদি সেই পরিমাণ মানসিক সামর্থ্যই না থাকে সেক্ষেত্রে প্রযুক্তি কীভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে বিভেদ দূর করার সক্ষমতা উন্নয়ন করতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। আশা করি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল আরও অধিক গুরুত্বের সাথে ভেবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। 


পরিশেষে আরও একবার বলতে চাই, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উন্নয়নে সমাজ ও মানুষের মনস্তাত্তিক গঠন পরিবর্তন সম্ভব নয়। সুতরাং নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য চাই যথাযথ কর্মসূচি এবং তার কঠোর প্রয়োগ। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আইনি ও সামাজিক সচেতনতা প্রক্রিয়া ছাড়া কোনোরূপ প্রযুক্তিই এই রোগ দমনে ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই বিশ্বাস করি।  



নারীদিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি বিশ্বের সকল প্রান্তিক নারীকে, সকল সংগ্রামী নারীকে, কামনা করছি নারীর জয়যাত্রার। এক ধাপ এগিয়ে গেলে নারী পৃথিবী এগোয় দশ ধাপ।


(তথ্যসূত্র- ইউএন এবং ইউএন উইমেন এর ওয়েবসাইট, প্রতিবেদন ডিসেম্বর ২৬, ২০২২, দৈনিক প্রথম আলো, সময় টিভি নিউজ, মার্চ ৬, ২০২৩।)


লেখক : সঙ্গীতা ইয়াসমিন, স্পেশাল এডুকেশনাল টিচার, টরেন্টো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, টরন্টো, কানাডা.


বিবার্তা/এসবি


 

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com