শিরোনাম
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন বাংলাদেশেরই জন্মদিন
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২১, ০৯:২০
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন বাংলাদেশেরই জন্মদিন
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ শুভ জন্মদিন। উৎসবমুখর মহা আনন্দের-মহোৎসবের এই দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জাতির আবেগমথিত হৃদয়ের অতল গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিবেদন। বিশ্বরাজনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার মোহনবাঁশিতে জাদুকরী সুর তিনি তুলেছিলেন। একটি জাতিকে তিনি এক মোহনায় মিলিত করে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক। ’৭১-এর সেই ৭ মার্চ ১৮ মিনিটের ভাষণে কি আবেগ, কি ভাষার জাদু, কি যুক্তি আর যুদ্ধের রণকৌশল! রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন মানেই আজ বাংলাদেশের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবিনাশী আত্মা। এমন সুদর্শন দীর্ঘকায় সুপুরুষ, চরিত্রে ব্যক্তিত্বে বীরত্বে বাঙালি নেতা পৃথিবীতে অতীতে কখনো আসেননি। ভবিষ্যতেও আর আসবেন না। হাজার বছরে এমন মহানায়কের আবির্ভাব ঘটে না রাজনীতিতে।


মহামানব জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার শ্যামলছায়া গাঁয়। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ছেলেবেলায় বাবা-মা ডাকতেন খোকা বলে। কিশোর বয়সেই মানুষের প্রতি অগাধ মায়া-মমতা। গরিবের পাশে দাঁড়ানো চরিত্রে দেখা যায়। অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর। মা আদরে প্রশ্রয় দিতেন। বাবা চাইতেন লেখাপড়া করবে। ব্যারিস্টার হবে। ছেলে অল্প বয়সেই পাঠ নিলেন রাজনীতিতে। কলকাতায় পাঠানো হলো পড়াশোনায়। সেখানেই ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়। নেতৃত্বে সাহসে সাংগঠনিক ক্যারিশমায় রাজপথের প্রতিবাদে নজর কাড়লেন সবার। তরুণদের মুজিব ভাই হতে থাকলেন। তারপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ালেন। স্নেহ-সান্নিধ্য পেলেন মহাত্মা গান্ধীর। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের। মওলানা ভাসানীর পরে। শেরেবাংলা সম্পর্কে নানা হলেও তাঁর নেতা হলেন সোহরাওয়ার্দী। একজন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে সততা সাহস নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে, দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর মমতা নিয়ে তিনি রাজনীতির মঞ্চে তাঁর আবির্ভাব ঘটালেন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জিন্নাহ ইসলাম মুসলমান পাকিস্তান- এ চার অনুভূতি নিয়ে জন্ম নিলে শেখ মুজিবুর রহমান এটাকে মেনে নেননি। এক বছর না যেতেই তিনি ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি রুমে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। পরের বছরই আওয়ামী লীগের জন্ম। কারাগারে বসে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও কর্মীদরদি মন আর সাংগঠনিক শক্তিতে তিনিই হলেন দলের প্রাণ-মধ্যমণি। ভাসানী বেরিয়ে গেলেন। সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যু, পাকিস্তানি শাসকদের কঠিন দুঃশাসন, তাদের প্রতাপশালী তাঁবেদার রাজনৈতিক শক্তি, সব প্রতিকূলতা তাঁকে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের সিঁড়িপথে জেল-জুলুম সয়ে একটি জাতিকে ছয় দফা থেকে স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে তিনি জাগালেন। ’৬৯ সালে ৩৮ মাসের কারাশৃঙ্খল ভেঙে তিনি গণঅভ্যুত্থানে বের হলেন যখন তখন জাতির অবিসংবাদিত নেতাই নন, নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন লাখ লাখ মানুষের চিৎকারে আনন্দে। তিনিই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন দুর্র্ধষ সাহসে লড়েছেন এবং সব পরিকল্পনায় কোথাও ভুল না করে সফল হয়েছেন। কোনো আলোচনার পথে নয়, কোনো গোপন রাজনীতির অন্ধকার পথেও নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে জনগণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জনগণকে নিয়ে অকুতোভয় এক দুঃসাহসী নেতা হিসেবে এ বিপ্লবের বিরল ইতিহাস গড়েছেন। ’৭০-এর নির্বাচনে তিনি ঐক্য গড়েননি, নিজের ইমেজে দলকে নিরঙ্কুশ বিজয়ে জাতির নির্বাচিত একক নেতার উচ্চতায়ই বসাননি, স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ বাংলায় জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করেছেন। তিনি স্বাধীনতার ডাকে যে মোহনবাঁশিতে সুর তুলেছিলেন গোটা জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ গণহত্যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সেই সুরের জাদুতে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলে। তিনিই প্রমাণ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতায় জীবন তুচ্ছ। ত্যাগের কোনো বিকল্প নেই। তাঁর পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধে কত রক্ত আর লড়াইয়ে বিজয়ী আমরা। ৫৫ বছরের জীবনে ৫০ বছরেই তিনি জাতির পিতা হলেন। একজন মহান নেতা এমনি হয় না। ৫০ বছরের ১৩ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। ফাঁসির রশি বারবার ঝুলেছে, কবর খোঁড়া হয়েছে, আপস তাঁর চরিত্রে ছিল না। দেশটাই বাড়ি জনগণই তাঁর পরিবার। এমন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও বিশ্বের তাবৎ শোষিত মানুষের হয়ে তেজোদীপ্ত ভরাট কণ্ঠের তেজস্বী ভাষণ ও কোমল হৃদয়ের উদার গণতান্ত্রিক নেতা বিশ্বরাজনীতিতে আসবেন না। ’৭১-এর মার্চে পাকিস্তানি শাসকদের অস্ত্রের শাসনকে অচল করে দিয়ে গোটা দেশে ক্ষমতায় না গিয়ে প্রতিটি নির্দেশ জনগণের মাঝে কার্যকর করে তিনিই বলতে পেরেছিলেন, আমিই রাষ্ট্র। এই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের আদর্শ। বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেই সৎ নির্লোভ চরিত্রে দেশ ও মানুষকে, জনগণের স্বার্থকে হৃদয়ের ভালোবাসায় ধারণ করে মানবকল্যাণে নিবেদিত করা। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত মানবিক উন্নত আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ।


এ দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বহু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সত্যকে আড়াল করতে যে-যার মতো লজ্জাজনকভাবে মিথ্যাচার করেছেন। ইতিহাস বিকৃতির নির্লজ্জ বেহায়াপনায় যার যার মতোন বলেছেন ও লিখেছেন কিন্তু পাকিস্তানের গোয়েন্দা নথি থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের অবমুক্ত দলিল, পরাজিত শক্তির লেখা বইসহ সবখানে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার একমাত্র স্তম্ভ। গৌরবের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পাশে থাকা ভারতের নথিপত্র থেকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মূল সত্য এখনো বহাল। সব সূত্র বলছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সে লক্ষ্য অর্জনে সফলতা-দক্ষতার সঙ্গে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম দুর্র্ধর্ষ এক সাহসী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, মহানায়ক ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধ তাঁর ডাকেই সংঘটিত হয়েছে। সবকিছুর মূলে ছিল তাঁরই পরিকল্পনা এবং নির্দেশ। বঙ্গবন্ধুর মোহনবাঁশিতেই ’৭১ সালের মার্চে গোটা জাতি উত্তাল হয়ে তাঁর অঙ্গুলি হেলনে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে।
ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি এখন লন্ডনে অবসর জীবনের পড়ন্ত বেলায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতি জওহরলাল নেহেরুকে লেখা চিঠি হস্তান্তর করে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জিকে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের কাছে সমমর্যাদার বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে সমর্থন চাইছি। মাথা নত করে হাত পাতছি না। চীনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ভারত এখন দুনিয়ায় ইজ্জত হারিয়েছে। আমাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা ও সমর্থন দিলে ভারতের হারানো ইজ্জত যেমন ফিরে আসবে, মর্যাদা যেমন বাড়বে; তেমনি আমার বাঙালি স্বাধীন আবাসভূমি পাবে। আমরা স্বাধীন হব।’ সে সময় পূর্ববাংলার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপ-হাইকমিশনের রাজনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় এসব কথা বলেছেন। ১০ জুলাই ২০১৯, সামারের চমৎকার বিকালে তাঁর লন্ডনের বাসভবনে টানা দুই ঘণ্টা তিনি আমার সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধুই যে মহান স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, পরিকল্পনাকারী এবং দুঃসাহসী নেতা হিসেবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাস্তবায়ন করেন তার নির্মোহ ইতিহাস তুলে ধরেন।


১৯৫৫ সালে ফরেন চাকরিতে যোগ দেয়া শশাঙ্ক ব্যানার্জি ’৮৫ সালে অবসর নেন। ’৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার আগ পর্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এমন সুপুরুষ, এমন কণ্ঠ ও সহজ সরল ভাষার বক্তৃতায় জনগণকে তীব্রভাবে আকর্ষণ, উদ্দীপ্ত, উত্তেজিত ও সংগঠিত করার মতোন একজন অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক ও অমায়িক ব্যবহারের বিচক্ষণ নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।


শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেছেন, ১৯৬২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ছিল খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের উৎসব। তখন তিনি পুরান ঢাকার চক্রবর্তী ভিলায় বসবাস করেন। বাড়িটির পাশেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাক অফিস। ২৪ ডিসেম্বর রাতে তিনি তাঁর সহধর্মিণীসহ এক সহকর্মীর বাসায় বড়দিনের আনন্দ অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ শেষে রাত ১২টার পরপর বাসায় ফিরে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পান। দরজা খুলে দেখেন ১৪ বছরের এক ভদ্র, বিনয়ী অচেনা কিশোর দাঁড়িয়ে। সালাম বিনিময় করে সেই কিশোর ছেলেটি তাঁকে বলল, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আপনাকে নিয়ে যেতে আমাকে পাঠিয়েছেন। দরজা খোলার আগে কড়া নাড়ার শব্দে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, মধ্যরাতের পর এই অসময়ে কে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। তিনি ভ্রুকুঁচকে ভাবছিলেন, কেউ কি তাঁকে অনুসরণ করছিল? ঢাকায় আসার আগে তাঁকে নিজের এবং পরিবারের অতিরিক্ত নিরাপত্তায় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখা নিয়মিত পড়ে মুগ্ধ হলেও কখনো দেখা হয়নি। ছেলেটি আরও বলল, মানিক মিয়ার সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক আছেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোক কে- ছেলেটি তা আর বলল না। তিনি ইতস্তত করে করে গোলকধাঁধার মতো মানিক মিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বসলেন। যা ছিল প্রথাবিরোধী। ব্যানার্জি বলেন, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যা-ই ঘটুক না কেন আমি সেই অজানার উদ্দেশে যাব।’ ছেলেটিকে বলে দিলেন চলে যেতে এবং মানিক মিয়াকে জানাতে যে, কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দেখা করতে আসছেন।


শশাঙ্ক ব্যানার্জির ভাষায়, পরিচয়ের সময় মুজিব শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং তাঁকে তুমি সম্বোধনে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাঁকে বললেন, আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে তুমি বলতে পারব না। শেখ মুজিব তাঁর চোখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন ভীষণ জরুরি একটা কিছু বলার জন্য তিনি উশখুশ করছেন। হাসিমুখে চোখ মিটমিট করে তাঁকে ব্যানার্জি বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। তবে জানতে চাইছি এটা কি একটি ঐতিহাসিক করমর্দন? শেখ মুজিবের ত্বরিৎ জবাব ছিল, কেন নয়? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বলেছিলেন, এই সোভিয়েত নেতার সঙ্গে পশ্চিমের লেনদেন সম্ভব। তেমনি এ ঘটনার অনেক বছর আগে ’৬২ সালের শীতের রাতে তাঁর মনেও যে গোপন কথাটি দানা বেঁধে উঠেছিল সেটি হচ্ছে, ‘শেখ মুজিবের সঙ্গে ভারতের লেনদেন সম্ভব।’ সেদিন শেখ মুজিবের পরনে ছিল লুঙ্গি, পায়ে চপ্পল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে পাঞ্জাবি ও চাদর। শেখ মুজিবকে তিনি বললেন, এই অধমের সঙ্গে আপনি কেন দেখা করতে চাইলেন? কেন ডাকলেন? তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে। আমি প্রশ্ন করলাম, গণতন্ত্রের জন্য কি ভারতের কাছে সাহায্য চান? তিনি কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, না। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করলেও আমি পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে যেটির কথা চিন্তা করছি, সেটি শুনলে চমকে উঠবে না তো? শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি তখন বিস্ময় নিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। মুজিব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি পূর্ববাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছি। শেখ মুজিবের কথা শুনে আমি শুধু চমকেই যাইনি, রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেলাম। অবাক হয়ে বললাম, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যদি জানে তবে জানে মেরে ফেলবে। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা প্রকাশ হবে না তো! প্রকাশ হলে দেশদ্রোহী মামলা হবে। সাবধান! এভাবে ওপেন বলবেন না। আপনাদের প্রাণ তো যাবেই; ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তবে আপনারা নিশ্চিত থাকুন, আমার তরফ থেকে এটি ফাঁস হবে না। মুজিব বললেন, তাদের তরফ থেকেও ফাঁস হবে না। ব্যানার্জি বলেন, সেদিন এই দুই মহান ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হলেও তাঁদের কর্মকা-ের সঙ্গে তিনি মানসিকভাবে জড়িয়ে ছিলেন। নেহেরু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি দেখে যেতে না পারলেও বিশ্বাস করতেন একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্বের যোগ্যতা রাখেন। আর ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর অবলোকন করেছেন একজন সাহসী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব তাঁর জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে কীভাবে ত্বরান্বিত করে তাঁর দলকে জনপ্রিয় ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পথে সফলভাবে ইতি টেনেছেন। তার স্বপ্নের বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন।


কেবল শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির বক্তব্যেই নয়, এ দেশের সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গোয়েন্দা নথি সবখানেই স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামই উচ্চারিত হয়েছে।


আমির হোসেন আমুর কাছ থেকে জানা যায়, সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৫ দলের বৈঠক বিভিন্ন দলের অফিসে বা নেতাদের বাসায় হতো। সে সময় একটি বৈঠক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ কার্যালয়ে হয়েছিল। বৈঠকের একপর্যায়ে বিরতিকালে পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁকে ন্যাপ সভাপতি ও মুজিবনগর সরকারের আরেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফ্ফরের কক্ষে নিয়ে যান। সে সময় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদও তাঁকে বলেছেন, ‘তোমাদের নেতা শেখ মুজিব কোনো দিন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমরা যখন গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করতে বসলাম তখন তিনি আমার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দেন। তাতে লেখা ছিল, “যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবে এবং পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বিরোধিতা করবে তাদের কমিটিতে রাখা যাবে না”।’


আমির হোসেন আমু বলেন, সে সময়কার পরিস্থিতি এখন বসে ভাবলে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে তখন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। ইসলাম, জিন্নাহ, পাকিস্তান, মুসলমান তখন একাকার। এ অবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে দেওয়া দুঃসাহসিক লড়াই ছিল, যা সাদামাটাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেকে মনে করতে পারেন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ খুব সহজেই স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আসার সংগ্রাম যে কতটা কঠিন ছিল তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যে লড়াই শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তিনিই কেবল বুঝেছেন।


লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।


বিবার্তা/এনকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com