বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় জার্মানি: রাষ্ট্রদূত লোটজ
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ২২:০৯
বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় জার্মানি:  রাষ্ট্রদূত লোটজ
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশা করে জার্মানি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশটি চায়, আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত হবে। ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লোটজ আজ বুধবার 'ডিকাব টক' অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।


কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ডিকাবের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে ডিকাব সভাপতি একেএম মঈনুদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুজ্জামান মামুন বক্তব্য দেন।


আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মন্তব্য করে রাষ্ট্রদূত রুডিগার বলেন, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহম্মদ ইউনূস আগামী নির্বাচন অংশগ্রহনমূলক ও উৎসবমুখর পরিবেশে হবে বলে জানিয়েছেন এবং ৬০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেছেন। আমরা তার এই বক্তব্যের প্রতি আস্থা রাখি।


তিনি আরও বলেন, “আমি মনে করি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং উচ্চমাত্রার ভোটার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই আমি দেখতে চাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণা, যেখানে দলগুলো পারস্পরিক রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বিরত থাকবে।”


অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমরা যখন বলি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, তখন এর অর্থ হলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নাগরিকরা বাধা ছাড়াই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এর মধ্যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ, হুমকিমুক্ত প্রচারণা এবং সঠিকভাবে ফলাফল গণনার নিশ্চয়তাও থাকবে। নির্বাচন হতে হবে এমন যেখানে কেউ ভীত নয়। সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে। আর বাংলাদেশ সেই পথেই এগুচ্ছে।"


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে ভোটার উপস্থিতি ৫০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে থাকে, এবং তা নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। ভোটার উপস্থিতি যত বেশি, তত ভালো।


অনুষ্ঠানের শুরুতে মূলবক্তব্যে রাষ্ট্রদূত বলেন, "২০২৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করবে। ১ কোটি ২৭ মিলিয়ন ভোটারের বড় অংশ তরুণ। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়া একটি দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী বার্তা দিবে। আগামী নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জার্মানি সমর্থন দেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইইউ একটি বড় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠাবে।


শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যা বললেন রাষ্ট্রদূত: এক প্রশ্নের জবাবে আইনের শাসন ফেরাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার জরুরি ছিল মন্তব্য করে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটজ বলেন, ন্যায়ের জন্য আগের সরকারের অন্যায় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বড় কোন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এটি যেকোনো দেশের জন্যই প্রয়োজন। তবে ইইউ'র নীতি অনুসারে জার্মানি মৃত‍্যুদণ্ড সমর্থন করে না।


এই পদক্ষেপ অবশ্যই আইনের শাসনের মূলনীতির প্রতি সম্মান রেখে হতে হবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি। এটি শুধু এই মামলায় ( শেখ হাসিনার মামলা) নয়, আগের সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই সরকার ও বিচার বিভাগকে আরও গভীরভাবে দেখতে হবে যে আইনের শাসন যথাযথভাবে মানা হয়েছে কি না।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের মতো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে জার্মানি আশ্রয় দেবে কিনা জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, এমন কোনো অনুরোধ তারা পাননি। এটা যদি কখনো হয়, তখন আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই মুহুর্তে এটা এতটাই তাত্ত্বিক প্রশ্ন যে, তিনি এখনই সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না। তবে সে সময়ের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়।


ঢাকা-বার্লিন সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে এয়ারবাস ইস্যু: এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার ‘প্রতিশ্রুতি’ থেকে বাংলাদেশ সরে এলে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে ‘প্রভাব পড়বে’ মন্তব্য করে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটজ বলেন, ইউরোপের বাজারে শুল্কছাড়ের আলোচনাও এয়ারবাস নিয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের কারণে বদলে যেতে পারে।


তিনি বলেন, জিএসপি প্লাসের প্রশ্নে হুমকি দেওয়া বা তেমন কিছু না। দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলো এ ধরনের (এয়ারবাস) সিদ্ধান্তের উপর কিছুটা নির্ভর করে। তাই জিএসপি প্লাসের সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত বা দরকষাকষি কীভাবে চলবে, এখানে নেওয়া এয়ারবাস বিষয়ক সিদ্ধান্ত তার পরিবেশ কিছুটা পরিবর্তন করবে। তবে এয়ারবাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন।
শিক্ষার্থী ভিসা পেতে সঠিক তথ্য দেয়ার পরামর্শ: এক প্রশ্নের জবাবে জার্মান রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের তার দেশের ভিসা পেতে সঠিক তথ্য দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, স্টুডেন্ট ভিসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ভুয়া তথ্য বা সঠিকভাবে আবেদন না করা। যা ভিসা দেয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঠিক তথ্য ও ডক্যুমেন্ট দিয়ে আবেদনের পরামর্শ দেন তিনি।


সংস্কার, জাতীয় সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রসঙ্গ: দীর্ঘমেয়াদে বা স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের একটি জাতীয় সংলাপ এবং রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন বলে মনে করেন জার্মান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, আমি মনে করি এটি বহু বছর ধরে এখানে অনুপস্থিত ছিল। দেশকে আবার ঐক্যে আসতে হবে। আমি বুঝতে পারি পরিস্থিতি কঠিন। বিশেষ করে যখন আগের সরকারের প্রতিনিধিরা তাদের অন্যায় ও ভুল স্বীকার করতে রাজি নন। এমন বাস্তবতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর যে-ই ক্ষমতায় আসুক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি রিকনসিলিয়েশনের উদ্যোগ নিতে হবে। যেন সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে সমঝোতামূলক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। কারন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন পরবর্তী সময়েও সংস্কার প্রক্রিয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা উচিত মন্তব্য করে বলেন, জুলাই সনদ অনুসারে সংস্কার প্রক্রিয়া নির্বাচনের পরেও চলমান থাকা দরকার। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক মনোভাব দেখছি।


আঞ্চলিক সহযোগিতায় গুরুত্ব : ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, এই অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম। এটি পুরো অঞ্চলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলা করা উচিত।


তিনি আরও বলেন, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা সবসময় থাকবে। আর ভৌগোলিক অবস্থানও পরিবর্তন হবে না। ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে থাকবে এবং চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি একটি দেশের সরকারের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত।


তিনি জানান, তার মেয়াদে তিনি রাজনৈতিক সংলাপে ভূমিকা রাখা, উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সফর এবং আরও জার্মান ব্যবসায়ীকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি এদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও পরিবেশ অনুকূল রয়েছে বলেও মনে করেন। এসময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে জার্মানি বাংলাদেশের পাশে আছে বলেও জানান রাষ্ট্রদূত।


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com