
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের পঞ্চম দিন শুক্রবার সকাল থেকে নুনিয়ারছড়া ও নতুন বাহারছড়ার অংশে কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা ছিল বিআইডব্লিউটিএসহ প্রশাসনের।
এর জন্য বুলডোজার নিয়ে ওই এলাকায় যাওয়ার চেষ্টাও করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা এগিয়ে গেলেও যেতে পারেননি বেশি দূর।
এর আগেই শুক্রবার সকাল থেকেই শহরের প্রধান সড়কের পাশাপাশি বিমানবন্দর সড়কে নেমে আসে শত শত স্থানীয় জনতা। শুরু করে বিক্ষোভ, ৪ রাস্তার মোড়ে দেয়া হয় ব্যারিকেড, জ্বালিয়ে দেয়া হয় টায়ার। গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়কে ঠেলা গাড়ি ফেলে তৈরি করা হয় প্রতিবন্ধকতা।
উপস্থিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবরোধকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় আলাপ কতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের সরানো যায়নি। তারা এক ব্যাখ্যা বলেছেন, এই উচ্ছেদ অভিযান অবৈধ। খতিয়ানভুক্ত জমিতে খাজনা দিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন তারা। প্রাণ দেবে তবু উচ্ছেদ হতে দেবে না।
এতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ এর উচ্ছেদ অভিযানের কর্মিরা যানবাহন সহ আটকা পড়েন। এসময় প্রধান সড়কের পাশাপাশি বিমানবন্দর সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ জানান।
এমন পরিস্থিতিতে উচ্ছেদ অভিযান সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। বুলডোজার সহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এরপর পিছু গেলে অবরোধকারিদের সরিয়ে দেন রাজনৈতিক নেতারা। বেলা ১২ টার পর প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, ‘উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়ে পুরো কক্সবাজারবাসী আতংকের পাশাপাশি নানা প্রশ্নের দেখা দিয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এটা করা হচ্ছে কিনা, তা এখন ভেবে দেখার বিষয়। এখানে নদীর তীর বলে উচ্ছেদ করা জায়গা অনেক পুরাতন বসতি। যাদের খতিয়ান ও খাজনা দেয়ার কাগজপত্র রয়েছে। এসব পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন। প্রশাসন শুনেছেন। জনতাও অবরোধ প্রত্যাহার করে ঘরে ফিরেছেন। এবার শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। সাধারণ মানুষকে আতংকে রাখার কোন অর্থ হয় না।
এব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ এর কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কথা বলতে রাজী হননি।
গত সোমবার থেকে শুরু হয়েছে বাঁকখালী নদীর তীর উচ্ছেদ অভিযান। প্রথম দুইদিনে স্বাভাবিক উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হলেও তৃতীয় দিন জনতার বাঁধা বন্ধ রাখা হয়। চতুর্থ দিন অভিযান পরিচালনা হয়। পঞ্চম দিন বন্ধ রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে দ্বিতীয় দিন পুলিশের উপর হামলা এবং তৃতীয় দিনের প্রতিবন্ধকতার ঘটনায় পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ পক্ষে দুইটি মামলা হয়েছে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬৫০ জনকে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে উৎপত্তি হয়ে ৮১ কিলোমিটারের বাঁকখালী নদীটি রামু ও কক্সবাজার সদর হয়ে শহরের কস্তুরাঘাট-নুনিয়াছটা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি দখলের ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ থেকে ১২ বছরে এই ছয় কিলোমিটারে ১ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় ভূমি অফিস এবং বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের পৃথক তালিকা তৈরি করেছে। সহস্রাধিক অবৈধ দখলদার থাকলেও দুই তালিকায় স্থান পেয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ জন প্রভাবশালী।
বিআইডব্লিউটিএ-এর সূত্র মতে, ২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার বিআইডব্লিউটিএকে বাঁকখালী নদীবন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করে। প্রজ্ঞাপনে নদী তীরের ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। জমি বুঝিয়ে দিতে বারবার জেলা প্রশাসনকে জানানো হলেও তারা তা দেয়নি। ফলে নদীবন্দর প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় দখল অব্যাহত ছিল।
যার সূত্র ধরে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ যৌথ অভিযান চালিয়ে ৬ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। তখন দখলমুক্ত করা হয় বাঁকখালী নদীর ৩০০ একরের বেশি প্যারাবনের জমি। কিন্তু পরে তা আবারও দখল হয়ে যায়। উচ্ছেদ করা প্যারাভূমিতে ফের নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা।
এর মধ্যে বাঁকখালী নদীর সীমানায় থাকা সব দখলদারের তালিকা তৈরি করে আগামী চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ আগস্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
মামলার রায়ে বলা হয়, কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর বর্তমান প্রবাহ এবং আরএস জরিপের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণপূর্বক নদীটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া নদীর সীমানায় থাকা সব দখলদারের তালিকা তৈরি করে আগামী চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
যার সূত্র ধরে শনিবার কক্সবাজার সফরে আসেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক বাঁকখালী নদী দূষণ ও দখলমুক্তকরণের লক্ষ্যে বিশেষ সমন্বয় সভা'য় প্রধান অতিথি ছিলেন। সভা শেষে তিনি কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে।
এসময় তিনি কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর দখলদারদের সমন্বিত তালিকা করে উচ্ছেদ করা হবে বলে জানিয়েছেন। যার সূত্র ধরেই সোমবার শুরু হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান।
বিবার্তা/ফরহাদ/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]