দৌলতপুরে দশমাসে ১০ খুন, দায় নিতে নারাজ প্রশাসন
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ১৪:৪২
দৌলতপুরে দশমাসে ১০ খুন, দায় নিতে নারাজ প্রশাসন
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী উপজেলা দৌলতপুর অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। গত ১০ মাসে ১০ হত্যাকাণ্ডসহ একের পর এক ঘটছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনা। আধিপত্য বিস্তরসহ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ঘটছে হামলা-মামলার ঘটনাও। প্রশাসনের কাছে গিয়েও মিলছেনা তেমন প্রতিকার। যা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সাধারণ মানুষ। তারা দুষছেন প্রশাসনের নিস্ক্রীয়তাকে। তবে এর দায় নিতে নারাজ পুলিশ প্রশাসন। তারা বলছেন সবই স্বাভাবিক রয়েছে।


বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, প্রকাশ্যে ছিনতাই, অস্ত্রের মহড়া ও হামলার ঘটনা এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়েদাড়িয়েছে। প্রায়দিনই ঘটছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এবং নীরব চাঁদাবাজিতো রয়েছেই। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও মাদক ব্যবসাসহ নানা কারণে ঘটছে হামলা-মামলা এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। এ যেন অপরাধের বিরণক্ষেত্র্য। যা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয় উপজেলার যে কোন উন্নয়ন কাজেও ঠিকাদারদের দেওয়া হচ্ছে হুমকি। কাজের সাইডে করা হচ্ছে হামলা। বিভিন্ন পার্টির পরিচয়ে উড়োচিঠির মাধ্যমে চাওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদাঁ। থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরও মিলছেনা কোন প্রতিকার। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। আর এর জন্য প্রশাসকেই দায়ী করছেন তারা।


গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ উপজেলায় উদ্বেগজনক হারে অপরাধ প্রবণতা বাড়লেও অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা না থাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশেঅনিচ্ছুক ভুক্তভোগী অনেকেই।


প্রকাশ্য দিবালোকে ইউপি চেয়ারম্যান খুনসহ গত ১০ মাসে অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দিনে ও রাতে ৮ থেকে ১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা, চরের মহিষের বাথানের ৪৬টি মহিষ লুট, দেড় ডজনের বেশী গরু চুরির ঘটনাসহ চুরি, ডাকাতি ওচাঁদাবাজির ঘটনা নিত্যদিনের।


পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের জনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ৩০সেপ্টেম্বরে প্রকাশ্যে দিবালোকে নিজ কার্যালয়ে ফিলিপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নঈম উদ্দিন সেন্টুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে একের পর এক হত্যাকান্ডের ঘটতে থাকে। ছাতাপাড়া বাজারে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আপন দুই ভাইকে। আহত করা হয় বেশ ককেজনকে। মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের ইব্রাহিম প্রামানিকের ছেলে রাজু (১৮) নামে এক যুবককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পদ্মার চরে গুলি করে হত্যা করা হয়। দৌলতখালী দাড়পাড়া গ্রামে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় জাহানারা খাতুন নামে প্রতিবন্ধীকে। গোবরগাড়া গ্রামে জমি সংক্রান্ত মাহাফুজা খাতুনকে (৪৬) গৃহবধুকে ধারালো কুড়াল দিয়ে হত্যা করা হয়। দৌলতপুর সীমান্তের ঠোটারপাড়ায় মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষ মাদক চোরাকারবারীর হামলায় মাদক চোরাকারবারী মোহন (২৫) নিহত হয় এবং আহত হয় হৃদয় (২৪) নামে অপর মাদক চোরাকারবারী। মরিচা ইউনিয়নের ভুরকাপাড়ায় শহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৯জুন শেরপুর সেনপাড়া গ্রামের শিলা খাতুন (২০) নামে গৃহবধুর গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় বলে পরিবারের দাবি। সর্বশেষ ২ জুলাই রাতে মথুরাপুর স্কুল বাজারে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে আব্দুল আজিজ (৩০) নামে এক যুবক নিহতসহ গত ১০ মাসে ১০টি হত্যাকান্ড ঘটেছে।


হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রধান আসামিসহ অন্যান্য আসামি ধরাও পড়েছে। তবে তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বের হয়ে আবারও জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ কর্মকাণ্ডে। এছাড়াও ৭ ফেব্রুয়ারি একটি শিশু চুরির ঘটনা ঘটে যা দৌলতপুরবাসীকে নতুন উদ্বিগ্ন করে। শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, ছিনতাইয়ের ঘটনার চিত্র রয়েছে ভয়াবহ।


গত বছরের ২ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে উপজেলা বাজারের ফিড ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামকে অস্ত্রের মুখে মারপিট করে ব্যবসার ৫ লাখ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইলফোন ছিনতাই করে নেয় চল্লিশ বাহিনীর প্রধান রাখি ও তার বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনার কয়েকদিন আগে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়ি ফেরার পথে বেলা ১১টার দিকে শিতলাইপাড়া এলাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় মোটরসাইকেল যোগে আসা ছিনতাইকারীরা। ১৪ জানুয়ারী বিকেলে হরিণগাছী এলাকায় নগদের মার্কেটিং অফিসার কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ১ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা ছিনতাইয় করে নিয়েছে সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র।


গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে দৌলতখালী গ্রামে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কৃষক দম্পতিকে বেঁধে রেখে গরু ও ছাগল লুট করা হয়। ১লা মার্চ ভোরে ডাংমড়কা-মহিষকুন্ডি সড়কের আঞ্জুর আস্তানার কাছে ৪জন গরু ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের কাছে থাকা ব্যবসার ৭ লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নেয়। সীমান্তের শীর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী ও মাদক পাচারকারী চক্র আরিফ বাহিনী এ ছিনতাই ঘটনার সাথে জড়িত বলে সেসময় স্থানীয় সূত্র জানিয়েছিল।


২এপ্রিল সীমান্তের চরপাড়া এলাকায় ৭টি গরু লুট ও ছিনতাই হয় এবং একইদিন রাতে খলিসাকুন্ডি গ্রামে বাড়ির লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে ছিনতাইকারী চক্র।


১৪ এপ্রিল সোনাইকুন্ডি গ্রামে অস্ত্রের মুখে ব্যবসায়ীর আড়াই লাক্ষ টাকা ছিনতাই করে নেয় সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা।ফিলিপনগর ইউনিয়নের সিরাজনগর বেলতলীপাড়া গ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী হায়দার আলীর বাড়িতে সশস্ত্র ডাকাতদল বাড়ির লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ব্যবসার নগদ ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, ১ ভরি স্বর্ণালংকার ও প্রায় ১০০ ভরি রুপা লুট করে নেয়।


১ ফেব্রুয়ারি রাত ২টার দিকে উপজেলার আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নের তেকালা এলাকায় আতঙ্ক ছড়াতে একটি নির্মাণাধীন সেতুর শ্রমিকদের রাত্রি যাপনের অস্থায়ী ঘর লক্ষ্য করে ৫-৬টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হয়। পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুরে নির্মাণাধীন ব্রিজের শ্রমিকদের মারধর করে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে সন্ত্রাসী চক্র। পরে তারা ৫০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে উড়ো চিঠি দেয়।


এদিকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি সীমান্তে মাদক চোরাচালানকে কেন্দ্র করে চোরাকারবারি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এক মাদক চোরাকারবারি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের ইব্রাহিম প্রামাণিকের ছেলে রাজু হোসেন (১৮) নামে এক যুবককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পদ্মার চরে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের জের ধরে পরদিন সকালে একই এলাকার সাঈদ মণ্ডলের চরের বাথান থেকে অন্তত ৪৬টি মহিষ লুট করে সন্ত্রাসীরা। এমন অপরাধ কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন জনপ্রতিনিধিরাও।


দৌলতপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন দৌলতপুরের সাবেক এমপি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা। তিনি আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেছেন পুলিশের সাথে মাদকব্যবসায়ীদের সখ্যতা রয়েছে। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। তবে এসব ঘটনার দায় নিতে নারাজ দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নাজমূল হুদা। দৌলতপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরও তিনি দাবি করছেন, সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে।


সর্বোপরি দৌলতপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর ও সক্রিয় হতে হবে। তবেই ফিরবে দৌলতপুরবাসীর মাঝে স্বস্তি। আর এমনটাই মনে করেন সর্বসাধারণ।


বিবার্তা/শরীফুল/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com