কক্সবাজারের শালিক রেস্টুরেন্ট
নারী কর্মীদের যৌন নিপীড়ন ও যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করতে নির্যাতনের অভিযোগ
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ২০:১৪
নারী কর্মীদের যৌন নিপীড়ন ও যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করতে নির্যাতনের অভিযোগ
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

কক্সবাজারের পর্যটন জোনের কলাতলী এলাকায় অবস্থিত শালিক রেস্টুরেন্টের মালিকের বিরুদ্ধে নারী কর্মচারীদের যৌন নিপীড়ন ও জোরপূর্বক যৌনবৃত্তি করতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে এর প্রতিবাদ করলে অন্যান্য কর্মচারীদের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। যার জন্য তৈরি করা হয়েছে স্টাফ কোয়ার্টার নামের একটি বন্দিশালাও। যেখানে ২৪ ঘণ্টায় নিরাপত্তা নিয়োজিত থাকে মালিকের দেয়া অস্ত্রধারী কয়েকজন যুবক।


বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার সদর থানায় পৃথকভাবে দায়ের করা ২ টি মামলার এজাহার ও ঘটনায় শিকার ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপকালে এমন তথ্য মিলেছে। এর প্রতিবাদে কক্সবাজার হোটেল রেস্তোরাঁ শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে শনিবার দুপুরে মানববন্ধন করা হয়েছে। যেখানে শালিক রেস্টুরেন্টের অনেক কর্মচারীও উপস্থিত ছিলেন।


কক্সবাজার সদর থানার ওসি রকিবুজ্জামান জানান, শালিক রেস্টুরেন্টের ঘটনায় ২ টি এজাহার দায়ের করা হয়েছে। দুইটি ঘটনা একই। একজন নারী ও একজন পুরুষ কর্মচারী পৃথকভাবে এজাহার ২ টি দিয়েছেন। ফলে দুইটি একই ঘটনা হওয়ায় একটি এজাহারের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। তদন্তের পর প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।


এজহার ও স্বাক্ষীদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কলাতলীতে বহুল পরিচিত শালিক রেস্টুরেন্টের কর্মচারী হিসেবে ২১ জন নারীকে নানাভাবে নিয়োগ দিয়েছে মালিক নাছির উদ্দিন বাচ্চু। আর সব নারীই বয়সে তরুণী এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের। এসব কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে শর্ত দেয়া হয়েছে স্টাফ কোয়ার্টারের রাত্রি যাপন বাধ্যতামূলক। আর ওই স্টাফ কোয়ার্টার ঘিরে রয়েছে সশস্ত্র পাহারাদার। ওই স্টাফ কোয়ার্টারকে নির্যাতনের বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহার করেন শালিকের মালিক। যেখানে প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বাচ্চু।



কক্সবাজার সদর থানায় দায়ের করার ২ টি এজাহারের মধ্যে একটির বাদি উপজাতি সম্প্রদায়ের এক তরুণী। যার বাড়ি কক্সবাজারের পার্শ্ববর্তী বান্দরবন জেলার একটি উপজেলায়। ওই নারী গত ৬ মাস ধরে ওই রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। যেখানে তিনি প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।


কক্সবাজার সদর থানা প্রাঙ্গণে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ওই নারী। তিনি জানিয়েছেন, ১১ অক্টোবর ও ১২ অক্টোবর টানা নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ ফোন করার পর তিনি উদ্ধার হয়েছেন। পুলিশ তাকে উদ্ধার করার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। পুলিশের পরামর্শক্রমে লিখিত এজাহার দায়ের করেছেন।


লিখিত এজাহারটিতে উপজাতি ওই তরুনী বলেছেন, অসুস্থজনিত কারণে তিনি ছুটি নিয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে চলে যান। ওখান থেকে ঔষুধের জন্য বের হলে রেস্টুরেন্টের কর্মচারী খালেক ও আবদুল্লাহর সাথে দেখা হয়। ওই ২ জনকে তার অসুস্থতার বিষয়টি জানালে তারা ২ জন গিয়ে একটি ফার্মেসিতে গিয়ে ঔষধ ক্রয় করেন। এর মধ্যে মালিক বাচ্চু তাদের ফোন করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান। যাওয়ার পর পরই শুরু হয় মারধর। মারধর করতে করতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় স্টাফ কোয়ার্টারে। যেখানেও চালানো হয় নির্যাতন। একই সঙ্গে যৌন নিপীড়ন শুরু করেন বাচ্চু। যার এক পর্যায়ে কৌশলে পালিয়ে যান আবদুল্লাহ। সশস্ত্র পাহারার কারণে তিনি এবং খালেক পালাতে ব্যর্থ হন। পরে পুলিশের সহায়তা উদ্ধার হন।


খালেককে উদ্ধারের পর চকরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে চিকিৎসা নিলেও শুক্রবার রাতে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। আবদুল্লাহও একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।


আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, শালিকের মালিক কৌশলগত কারণে উপজাতি তরুণীদের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন বেশি। এসব নারীদের স্টাফ কোয়ার্টার নামের বন্দিশাখায় নিয়ে গিয়ে প্রায়শ চালানো হয় যৌন নিপীড়ন। একই সঙ্গে বিভিন্ন হোটেলে পাঠিয়ে যৌনবৃত্তি করতে চাপ প্রয়োগও করা হয়। মূলত তার এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার জের ধরে তাকে এবং আবদুল্লাহকে মারধর করা হয়। আর যে উপজাতি তরুণী এ ঘটনায় মামলার এজাহার দিয়েছেন তাকে প্রথমে নির্যাতন করা হয়েছে যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করার জন্য। এতে অসুস্থ হয়ে ঔষধ কিনতে গেলে তাদের সাথে দেখা হয়। এটা জেনে মালিক মনে করেছেন এই নারী কৌশলে পালিয়ে যাচ্ছেন। আর তিনি এবং খালেক এই নারীকে সহযোগিতা করছেন। মূলত এর জের ধরেই সর্বশেষ নির্যাতন চালানো হয়।


এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে কক্সবাজার হোটেল রেস্তোরাঁ শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ। যেখানে শালিক রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরাও উপস্থিত ছিলেন।


মানববন্ধনে দ্রুত সময়ের মধ্যে শালিক রেস্টুরেন্টের ঘটনার মামলা লিপিবদ্ধ করে বাচ্চুকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে জিম্মি থাকা শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রদানের দাবি জানান।


শ্রমিক লীগ নেতা রুহুল কাদের মানিকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, শ্রমিক নেতা রাশেদুর রহমান, আয়ুব আলী, মোহাম্মদ ছিদ্দিক, মোহাম্মদ জালাল, মোহাম্মদ হারুন, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।


বিষয়টি খুবই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি নাইমুল হক চৌধুরী টুটুল। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। শরীরে আঘাতে যে চিহ্ন দেখেছি তা অমানবিক। আহত ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে সমিতির পক্ষে আলাপও করা হয়েছে। বিষয়টি সমিতির পক্ষে নিজস্ব নিয়মে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি ফৌজদারি অপরাধে সংঘটিত ঘটনাটি পুলিশ নিজস্বভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।


বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার জন্য বৃহস্পতিবার রাত থেকে শনিবার বিকাল পর্যন্ত অভিযুক্ত শালিক রেস্টুরেন্টের মালিক নাছির উদ্দিনের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি তাকে একাধিক ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।


বিবার্তা/ফরহাদ/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com