চালুর আগেই বেঁকে গেল রেললাইন
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ২২:১৩
চালুর আগেই বেঁকে গেল রেললাইন
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে রেল যাওয়ার কথা। কিন্তু গত সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নির্মাণাধীন রেললাইনের নিচে মাটি ধসে কয়েক জায়গায় বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। এতে করে রেললাইনের নিচের গর্ত দিয়ে এপার থেকে ওপারে সাঁতারও কাটা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও রেললাইন দেবে গেছে। পাথর সরে যাওয়াসহ রেলবিটও খুলে গেছে। এ অবস্থায় সেপ্টেম্বরে ট্রেনে কক্সবাজার যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।


চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী এলাকায় বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে যায়। টানা অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকা গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ডুবতে শুরু করে ও মঙ্গলবার ভোরে রেললাইন পানিতে তলিয়ে যায়। পরদিন বুধবার পানি নামতে শুরু করে। এরপরই ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নজরে আসে।


দেখা যায় প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আদার মায়ের মাজার থেকে পাঠানপুল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রেললাইন। অন্তত ১০টি অংশে রেললাইন থেকে একেবারে পাথর সরে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বন্যায় তোড়ে পাথর পাশের জমিতে গিয়ে পড়েছে। রেললাইন দেবে গেছে, রেলবিটও উঠে গেছে। চলাচলের আগে এমন উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত ভাবে রেলপথ নির্মাণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ছোট ছোট যে কালভার্ট রাখা হয়েছে, সেগুলো পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়।


বিশেষজ্ঞদের মতে, রেললাইন নির্মাণের সময় এখানের অবস্থা বিবেচনায় নেয়া দরকার ছিল। যে অঞ্চলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখান দিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে সাগরে গিয়ে পড়ে। এখন রেললাইন করার ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। মানুষকে যেমন ভুগতে হচ্ছে, তেমনি রেলের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।


স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এলাকায় এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি। রেললাইনের কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ আটকে যাওয়ায় তাদের এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে। যদি রেললাইনে পর্যাপ্ত কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করা হতো, তাহলে এত ক্ষতি হতো না।


বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) রেলওয়ের কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন পরিদর্শন করে বলেন, এক কিলোমিটার জুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালু নিয়ে সমস্যা হবে না। বন্যার পানিতে রেললাইনের এ অবস্থার কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং তা সংস্কারে কত অর্থ ব্যয় হবে, তা এখনো পরিমাপ করা হয়নি বলে জানান তারা।


এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার রেললাইনে ২৪৫টি কালভার্ট ও ৩৯টি ব্রিজ নির্মাণের কথা জানালেও আদার মা মাজার থেকে মৌলভীর দোকান পর্যন্ত দুই কিলোমিটার জুড়ে মাত্র দুটি কালভার্ট দেখা গেছে। এসব কালভার্টের নিচ দিয়ে পানি খুব কমই নামছে। এতে দু-এক দিনের বৃষ্টিতে পানি জমে বাড়ি ঘরে উঠে যাচ্ছে।


দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৮৮ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকি আছে ১২ কিলোমিটার।


কক্সবাজার রেল প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এক থেকে দেড় কিলোমিটার রেললাইন সামান্য ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে গেলে সংস্কার করা হবে। রেললাইনের কারণে পানি ওঠার দাবিটি সঠিক নয় বলেও জানান তিনি।


এদিকে অপরিকল্পিত রেলপথের কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ মানতে নারাজ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা। প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ১০০ বছরের বন্যার বিষয়টিও হিসেবে রাখা হয়েছিল। যে অংশে রেললাইন ডুবেছে, সেখানে প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে লাইন করা হয়। এবার অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে রেললাইন


ডুবে গেছে। আর ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র এক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে মফিজুর রহমান বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কালভার্টের


সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। তার দাবি, যদি রেললাইনের কারণে বন্যা হতো, তাহলে এক পাশে পানি থাকত, অন্য পাশে থাকত না। কিন্তু এবার তো দুই পাশে সমান সমান পানি ছিল।


প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে রেললাইন চালু হওয়ার সম্ভাব্য সময়। এর আগেই সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন ঠিক করতে অন্তত পাঁচশ থেকে এক হাজার বাড়তি জনবল যুক্ত করতে হবে।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ এম শামসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পানিনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই অঞ্চল দিয়ে পাহাড়ি এলাকার ঢল দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের পথে রেললাইনের মাধ্যমে বাঁধ দেয়ায় পানি নামতে পারেনি। যেহেতু রেললাইন হয়ে গেছে, তাতে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন এ ধরনের বৃষ্টি আরও হবে। তখন রেললাইন আবার ডুববে। এতে স্বাভাবিকভাবই মানুষ প্রশ্ন তুলবেন রেলওয়ে পরিকল্পিতভাবে রেললাইন নির্মাণ করেনি।


বিবার্তা/ফরহাদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com