কক্সবাজারের ৬০ ইউনিয়নে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১৪:৫৬
কক্সবাজারের ৬০ ইউনিয়নে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বৃষ্টিতে পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে নতুন করে আরও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।


৮ আগস্ট, মঙ্গলবার বিকালে জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য বলছে, কক্সবাজার জেলায় এই পর্যন্ত জেলার ৯ টি উপজেলার ৬০ টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যেখানে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ২ লক্ষাধিক উল্লেখ করা হলেও এরসংখ্যা ৫ লাখের কাছা-কাছি দাবি করেছেন জনপ্রতিনিধি।


বন্যা পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রামুতে পানিতে ডুবে এক শিশু এবং পেকুয়ায় সাপের কামড়ে এক ব্যবসায়ী মারা যান।


এর আগে সোমবার পাহাড় ধসে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ জন এবং চকরিয়ায় ৩ জনের মৃত্যু হয়।


মঙ্গলবার বিকাল ৫ টায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশের পাঠানো এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে কক্সবাজারের ৯ টি উপজেলার মধ্যে সকল উপজেলার কম-বেশি ইউনিয়ন পানিবন্দি রয়েছে। বিকাল পর্যন্ত ৬০ ইউনিয়নের পানিবন্দি থাকার তথ্য জেলা প্রশাসন পেয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরের ৫টি, রামুর ৩টি, ঈদগাঁওর ৫টি, চকরিয়ার ১৮ টি, পেকুয়ার ৭ টি, মহেশখালীর ৫ টি, কুতুবদিয়ার ৬ টি, উখিয়ার ৫ টি, টেকনাফের ৬ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এই ৬০ ইউনিয়নের ২ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ দুর্গত অবস্থায় আছে। ৯ টি উপজেলার ২০৮ টি আশ্রয় কেন্দ্রে সাড়ে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নেয়ার তথ্য।


জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তথ্য বলছে, বন্যার কারণে জেলায় ইতোমধ্যে দেড় কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে সড়ক, কালভার্ট, কাঁচারাস্তা সবচেয়ে বেশি।


আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জৈষ্ঠ্য পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৬ টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭ মিলিমিটার। আগামি আরও ৩ দিনে বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। এতে পাহাড় ধ্বসের আশংকাও রয়েছে বলে জানান তিনি।


জেলায় সবেচেয়ে বেশি প্লাবিত এলাকা চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায়। ২ উপজেলার একটি পৌরসভা সহ ২৫ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়া তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে অন্তত আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।


স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, লোকজন জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলের প্রবেশমুখ সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন ও কাকারা ইউনিয়ন ৪-৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। জিদ্দাবাজার-কাকারা-মানিকপুর সড়কের কয়েকটি অংশের উপর দিয়ে মাতামুহুরী নদী থেকে উপচে আসা ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় বসতঘরগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শুকনো খাবার ছাড়া রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই গত দুইদিন ধরে।


চকরিয়ার লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, ফাঁসিয়াখালী, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী এবং পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, রাজাখালী, টৈটং, শিলখালী, বারবাকিয়া ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।


পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের মেহেরনামার বেঁড়িবাধটি ভেঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি লোকলয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এসব ইউনিয়নের নিচু গ্রামগুলোতেই পানি উঠেছে অধিক।


চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পানি যাতে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়, সেজন্য কাজ করছে।


এছাড়াও ৯নং ওয়ার্ডের ১নং বেড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।


সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন জানান, আমাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদীর সাথে লাগোয়া। এজন্য পাহাড় থেকে নেমে ঢলের পানি আগে আঘাত আনে এসব ইউনিয়নগুলোতে।


এই দুই ইউনিয়নে অধিকাংশ ঘর পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। গত দুইদিন ধরে তাদের রান্নার কাজও বন্ধ। শুধু শুকনো খাবার খেয়ে রয়েছে।


শীলখালী ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তারা এখন পানিবন্দি হয়ে আছে লোকজন।


টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদ চৌধুরী জানান, টানা বৃষ্টির পানিতে আমার ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে।


পেকুয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙা অংশ মেরামত করা না হলে আরো ভয়াবহ হবে পেকুয়ার জন্য। দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।


পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূর্বিতা চাকমা জানান, সকাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন সরজমিন পরিদর্শন করেছি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।


চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেছেন, বন্যা কবলিত প্রায় এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ লোক পারিবন্দি রয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষদের নিকস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যেসব মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার দেয়ার হচ্ছে।


তিনি আরও বলেন, এছাড়াও যারা ঘরবাড়ি ছেলে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছে না সেসব পরিবারগুলোকে প্রাথমিকভাবে শুকনো খাবার দিতে সকল চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছি। চকরিয়ার বন্যার ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে অবহিত করে ত্রাণ বরাদ্দ চেয়েছি।


রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ৩ হাজারের বেশী বসত বাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।


রামুতে কর্মরত পানি উন্নয়ন বোর্ডের গ্রেস রিডার রুহুল আমিন জানান, বাঁকখালী নদীতে পানির বিপদ সীমার চিহ্ন ৫ দশমিক ২৮ মিটার, কিন্তু সোমবার সন্ধ্যা থেকে পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করে ৫ দশমিক ৬৮ মিটারে প্রবাহিত হচ্ছিল।


কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম জানিয়েছেন, ইউনিয়নের ৫ শতাধিক বসত বাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।


এছাড়া অসংখ্য বসত ঘর ও মাছের খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিয়নের মনিরঝিল, বৈলতলা, চরপাড়া, গাছুয়াপাড়া, ডিককুল, ডেপারকুল, লামারপাড়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম পানিতে একাকার হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়ি থেকে পানিবন্দি অবস্থায় লোকজনকে উদ্ধার করা হয়েছে।


এছাড়া পাহাড়ের উপরে বসবাসকারিদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে ও সতর্ক থাকতে মাইকিং করা হয়েছে।


চাকমারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার জানিয়েছেন, কয়েকদিনের প্রবল বর্ষনে ইউনিয়নের ৩ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে নতুন চরপাড়া, ফুয়ারচর, নাসিরাপাড়া, পূর্ব মোহাম্মদ পুরা, উত্তর চাকমারকুল, পশ্চিম চাকমারকুল, আলী হোসেন সিকদারপাড়ার একাংশ, জালাইলতলীসহ বিভিন্নস্থানে লোকজন পানিবন্দি হয়ে মানবেতর সময় পার করছে। জারাইলতলী এলাকা গাছ পড়ে একটি বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে দুর্গত লোকজনকে উদ্ধার ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া মাইকিং করে লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে।


দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোদেস্তা বেগম রীনা জানিয়েছেন, অতিবর্ষনের ফলে ইউনিয়নের ৫টিরও বেশী গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে ২ শতাধিক বসত বাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাহাড় ধ্বস ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি রোধে জনসাধারণকে সজাগ থাকার জন্য পরিষদের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে।


এছাড়াও রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, ফতেখাঁরকুল, রশিদনগর, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নে বর্ষণের কারণে শত শত বসত বাড়ি পানিবন্দি থাকার খবর পাওয়া গেছে।


এছাড়া ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ, পোকখালী, ইসলামাবাদ ইউনিয়ন, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী, খুরুশকুল, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড, কুতুবদিয়ার ৬টি ইউনিয়ন, মহেশখালীর ৩ ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।


কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ার অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে উচ্চ জোয়ারের কারণে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। প্লাবিত এলাকায় ইতোমধ্যে ৫৮ মেট্টিন চাল ও ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সহায়তা দল কাজ করছেন। প্লাবিত এলাকা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উদ্ধার তৎপরতা সহ সার্বিক সহায়তার জন্য সেনা বাহিনী ও নৌ-বাহিনী মাঠে রয়েছেন।


বিবার্তা/ফরহাদ/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com