সুন্দরবনে দুবলা চরে শুঁটকির মৌসুম, জেলেদের সমুদ্রযাত্রা
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১:৫৮
সুন্দরবনে দুবলা চরে শুঁটকির মৌসুম, জেলেদের সমুদ্রযাত্রা
মোংলা থেকে জাহিদ রানা
প্রিন্ট অ-অ+

শুরু হয়েছে সুন্দরবনের দুবলার চরে শুঁটকি তৈরির মৌসুম। শুঁটকি পল্লি ফের হয়ে উঠবে কর্মব্যস্ত। জীবনের ঝুঁকি ও ঋণের বোঝা নিয়ে মৎস্য আহরণে সমুদ্রযাত্রা করছে জেলেরা। তারা সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলেছে উপকূলের জেলে-মহাজনেরা। সাগরে যেতে যে যার মত প্রস্তুত করছেন জাল, দড়ি, নৌকা-ট্রলার। কেউ কেউ গড়েছেন নতুন ট্রলার, আবার কেউ পুরাতন নৌকা মেরামত করে নিয়েছেন। প্রস্তুতি অনুযায়ী অনেকেই আগেভাগে রওনা দিচ্ছেন। আবার অনেকেই সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ইতোমধ্যে চলে এসেছে মোংলা পশুর নদীর পাড়ে।


রবিবার (৩ নভেম্বর) রাত ১২টার পরপরই দুবলার চরের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন জেলেরা। আগামী ৫ মাস তারা সেখানে থাকবেন। তৈরি করবেন বিভিন্ন জাতের মাছের শুঁটকি।



দুবলার চর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ, যা চর নামে হিন্দুধর্মের পুণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের মোট আয়তন প্রায় ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয় এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর।



দুবলার চরে তৈরি হয় জেলে গ্রাম। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শুকানোর কাজ। বর্ষা মৌসুমে ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহের আলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় জেলে পল্লি বসে। এই ক’মাস তারা মাছের শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে শুঁটকি পাইকারি বাজারে মজুদ ও বিক্রয় করা হয়।



সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ থেকে মাছ সংগ্রহের অনুমতি সাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করে। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পায়। প্রতি বছর বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কনসেনট্রেশন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। এছাড়া আহরিত শুঁটকি পরিমাপ করে নিয়ে ফেরার সময় মাছ ভেদে প্রদান করেন নির্ধারিত রাজস্ব।



শুধুমাত্র সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেনি জেলে পরিবারগুলো। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে ইতোমধ্যে পুঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা হারিয়েছেন অনেকে।


জেলেরা বলছেন, চড়া সুদে টাকা নিচ্ছেন সুদের কারবারিদের কাছ থেকে। কেউবা টাকা গ্রহণে এনজিও, বিভিন্ন ব্যাংক ও সমিতি থেকে ঋণ করেছেন। ঋণ, সুদের বোঝার সঙ্গে এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই ৫ মাসের এক অনিশ্চিত জীবন শুরু করতে চলছেন তারা।


বহদ্দার শুভংকর হালদার বিবার্তাকে বলেন, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। এবছরও পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ করেই সাগরে যাচ্ছি। সরকারিভাবে আমরা তেমন কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না।


তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায়সহ অসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ম্য দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল- এখন আছে কি না তা জানি না। তবে শুনেছি জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত নাকি আবার বেড়েছে।


জেলে সমর হালদার বিবার্তাকে বলেন, বনবিভাগের পাস নিয়েই আমরা রওনা হই সাগর পাড়ের দুবলার চরে। ধার-দেনা করেই আমাদের যেতে হয় সাগরে। তবে অনেকে এবার সুদে টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় স্বর্ণের জিনিস থুয়ে টাকা আনতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন সাগরে দস্যুদের উৎপাত না থাকলেও এবার নাকি দস্যুদের দেখা যাচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছাসের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি মাথায় নিয়েই দুবলায় যাত্রা শুরু করি আমরা হাজারো জেলে।


জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা শাখার সভাপতি বিদ্যুৎ মণ্ডল বিবার্তাকে বলেন, পাস পারমিট হাতে পাওয়ার পর আজ রবিবার মধ্য রাত থেকে সকল জেলেরা সমুদ্রে দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। আমরা এখান থেকে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়েই যাবো।


পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বিবার্তাকে বলেন, বনবিভাগের কাছ থেকে পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে নিজ নিজ এলাকা থেকে রওনা হয়ে জেলেদেরকে সরাসরি যেতে হবে দুবলার চরে। চরে ঘর বাড়ি বা দোকান-পাট তৈরি করার জন্য সুন্দরবনের কোনো গাছ কাটতে পারবে না। গত শুঁটকির মৌসুমে দুবলার চর থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছিল সাড়ে ৬ কোটি টাকার মতো। এবারও আমাদের আশা আছে সাড়ে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে।


বিবার্তা/রোমেল/এনএইচ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com