
চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড এলাকায় বেড়েছে অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশার দৌরাত্ম্য। এসব রিকশা ঘিরে চলছে চাঁদাবাজিও। চাঁদা আদায়ে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ। ট্রাফিক ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বড়রাস্তাসহ অলিগলি।
ফলে, প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। কারণ রিকশার চালক বেশিরভাগ কিশোর ও প্রতিবন্ধী। এসব অবৈধ গাড়ি চলাচল বন্ধে নীরব প্রশাসন।
জানা গেছে, নগরের চকবাজার ধুনিরপুল থেকে রাহাত্তারপুুল পর্যন্ত প্রতিদিন চলাচল করছে শত শত অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশা। ওই এলাকায় অবৈধভাবে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মাঝেমধ্যে ট্রাফিক পুলিশের লোক দেখানো অভিযানও চলে। তবে টাকার বিনিময়ে জায়গায় করা হয় ম্যানেজ। এছাড়া থানা-পুলিশকে নিয়মিত দেওয়া হয় মাসোয়ারা। এমন অভিযোগ সাধারণের।
এ লাইন নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠেছে একাধিক গ্রুপ। গ্রুপের সদস্যরা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। এ নিয়ে ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। গত সোমবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুর ২টার দিকে নগরের ধুনীরপুল এলাকায় চাঁদা না দেওয়ায় এক রিকশা চালককে মারধরে জখম করে চাঁদাবাজরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ধুনিরপুলের আশপাশে ব্যাটারি রিকশার ছড়াছড়ি। এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করছে। থানার টহল গাড়ির সামনেই বীরদর্পে আসা-যাওয়া করছে চালকরা। উঠানামা ভাড়া ১০ টাকা। এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণে দুজন লোক- একজন বৃদ্ধ আবু, আরেকজন যুবক দায়িত্ব পালন করছে নুর বিতানের সামনে। পুলিশ আসতে দেখলে তারা দুজন দ্রুত খবর পৌঁছে দেয় চালকদের কাছে।
স্থানীয়রা বলছেন, আগে চললেও নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু নতুন ওসির আসার পর থেকে তা দ্বিগুণ বেড়েছে। অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। অনেক পথচারী আহত হয়েছে।
রিকশা চালক কিশোর রকি, হাসান ও খালেক বিবার্তাকে জানান, প্রতিদিন ১০০ টাকা করে রাহাত্তারপুল এলাকার বাইট্টা রুবেলের ভাসমান চায়ের দোকানে জমা দিতে হয়। রুবেলের হয়ে কাজ করেন ইমন ও সোহেল। তারা টাকা না দিলে গাড়ি চালাতে ভয়ভীতি দেখায়। এ গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ১০ জনের মত। সবাই সকাল-রাতে বাইট্টা রুবেলের দোকানে বসে থাকে। বাইট্টা রুবেল তাদের গুরু।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, অবৈধ ব্যাটারি রিক্সা চলাচলে ট্রাফিক, টিআই ও থানা-পুলিশকে নিয়মিত মাসোয়ারা দেওয়া হয়। গ্যারেজ মালিক ও গাড়ির মালিক চালকদের কাছে থেকে নিয়মিত ম্যানেজের টাকা আদায় করেন। যারা টাকা দেন না তাদের গাড়ি অভিযানে ধরে করা হয় জরিমানা।
এ বিষয়ে জানতে চকবাজার এলাকার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) বিপ্লব দাশের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কথা বলতে নারাজ। তবে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে গতকাল চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ওয়ালিউদ্দীন আকবরের কাছে সরাসরি গেলেও তাকে থানায় পাওয়া যায়নি। ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি। একইদিন চকবাজার এলাকায় ধুনিরপুলি মোড়ে দীর্ঘক্ষণ দেখা গেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার জটলা। এর মধ্যে টহল পুলিশের একটি গাড়ি এলে এসব গাড়ি ধুনিরপুল থেকে খানিকটা সরে পশ্চিম বাকলিয়া সরকারি স্কুলের সামনে গিয়ে অবস্থা নেয় এবং সেখান থেকে যাত্রী ওঠানামা করতে থাকে। এদিকে বাকলিয়া এক্সেস রোডটি সম্প্রতি যান চলাচলে উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই দু’পাশ দখলে নিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। বাকলিয়া ও চকবাজারে এসব গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করেন দেলোয়ার নামের এক ব্যক্তি।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে হাইকোর্ট মহাসড়কে তিন চাকার ব্যাটারি রিক্সাসহ ২২ ধরনের যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেন। তবে এ আদেশ ‘মহাসড়ক’ কথা উল্লেখ থাকলেও ছিল না ‘সড়ক’ কথাটি। তাই আইনের ফাঁক বের করে এসব গাড়ির নিয়ন্ত্রণকারীরা মহাসড়কের বদলে অলিগলির সড়কে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি রিক্সা মালিক ফেডারেশনের (রেজি. নং-২৭) সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম মহানগর রিক্সা মালিক পরিষদের (১৯৯৩) সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিক মিয়া বিবার্তাকে বলেন, 'বর্তমানে বিভিন্ন থানা এলাকায় পুলিশের নামে নানা রঙের টোকেনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি হচ্ছে। যদিও পুলিশ বলছে তারা চাঁদাবাজির সাথে জড়িত নয়, তবে টোকেন বাণিজ্যের সাথে জড়িতদের তালিকা প্রকাশের পরও কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ পুলিশ কমিশনার (সদর) মো. আব্দুল ওয়ারিশ বিবার্তাকে বলেন, ‘এসব ব্যাটারি চালিত রিক্সা নগরে চলাচল সম্পূর্ণ অবৈধ। এগুলো চলাচল করতে হলে অবশ্যই একটি নীতিমালার মধ্যে এনে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হয়তো পুলিশের নাম দিয়ে কেউ সুবিধা নিচ্ছে, পুলিশের কোন সদস্য চাঁদাবাজির সাথে জড়িত থাকার কথা নয়, তবে বিষয়টি পুলিশেরও খতিয়ে দেখা উচিত। এসব রিক্সা ঘিরে চাঁদাবাজি করা উচিত নয়। যে বা যারাই এই চাঁদাবাজির সাথে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করছি।’
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বিবার্তাকে বলেন, ‘নানা কারণে নগরে ব্যাটারি রিক্সা চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। এদের কোন অনুমতিও নেই ফলে রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি মহল মোট অংকের চাঁদাবাজি করে নিজেদের পকেট ভারী করছে। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশনের এক সাধারণ সভায় এসব ব্যাটারি রিক্সাকে একটা নীতিমালায় আনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
বিবার্তা/রোমেল/সউদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]