বন্ধ ৩ বছর
পাবনা চিনিকলের প্রাণ ফেরার প্রতীক্ষায় শ্রমিক-কৃষক
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৪৮
পাবনা চিনিকলের প্রাণ ফেরার প্রতীক্ষায় শ্রমিক-কৃষক
পাবনা (ঈশ্বরদী) থেকে পলাশ হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+

পাবনা ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়ায় ৬০ একর জমির নিয়ে দৈনিক ১৫’শ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন পাবনা সুগার মিলটি ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ৭৯ কোটি টাকা ব্যায়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থায়নে স্থাপিত মিলটি ১৯৯৬-৯৭ মাড়াই মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু করে। পরের বছর ১৯৯৭-৯৮ মৌসুম থেকে বাণিজ্যিকভাবে মাড়াই মৌসুম চালু করে কারখানাটি। তবে উৎপাদন শুরুর পর থেকেই লোকসান গুনতে থাকে চিনিকলটি।


২০২০ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের কয়েকটি চিনি কলের সাথে পাবনা চিনিকলের আখমাড়াই বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকেই বন্ধ পাবনা চিনিকলের আখমাড়াই। যে মিলটিকে ঘিরে ছিল ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য, শ্রমিক-কর্মচারী, চাষিদের কোলাহলে মুখর থাকতো পুরো কারখানা এলাকা। এখন সে জায়গায় সুনসান নীরবতা। মারাই বন্ধের পর থেকে এ অঞ্চলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে আখ চাষ। আখ চাষে যে পরিমাণ লাভবান হতো- কৃষক অন্যান্য সবজী কিংবা ধান চাষে সে পরিমাণ লাভবান হচ্ছেন না৷ পাবনা চিনিকল বন্ধ থাকায় জেলার অনেক স্থানে বন্ধ হয়ে গেছে আখ চাষ।


আখ চাষী মোহাম্মদ মকবুল হোসেন বিবার্তাকে জানায়, আমরা যখন আখ চাষ করতাম তখন বিঘা প্রতি জমিতে ৪০-৫০ হাজার টাকা লাভ হতো। কিন্তু বর্তমানে অন্যান্য সবজি কিংবা ধান আবাদ করে সে পরিমাণ লাভ হচ্ছে না। এই সুগার মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের প্রচুর পরিমাণে লোকসান হচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন- এই সুগার মিলটিকে আবার চালু করুন।


আরেক আখচাষী আনছার আলী বিবার্তাকে জানান, চিনিকল চালু থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন। চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণায় গত বছর ১৫ বিঘায় আখ চাষ করেছেন। আগামীতে হয়ত আরও কমে যাবে।


তিনি বলেন, ভালো ফলন ও সঠিক সময়ে আখ বিক্রি করতে পারলে প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। কিন্তু সময়মতো বিক্রি করতে না পারলে আখ নষ্ট হয়ে যায়। তাই লোকসান ঠেকাতে দ্রুত আখ বিক্রি করার ব্যবস্থা করা দরকার।


পাবনার ঈশ্বরদীর আখচাষি আমজাদ হোসেন বিবার্তাকে বলেন, তারা বংশপরম্পরায় আখ চাষ করে আসছেন। চিনিকল বন্ধ হওয়ায় সংকটে পড়েছেন। তিনি বলেন, আখ চাষকে ভালোবাসেন বলেই বছরের পর বছর টাকা বাকি থাকা সত্ত্বেও এক যুগ ধরে আখচাষিরা তাদের আখ পাবনা সুগার মিলে সরবরাহ করে আসছেন। অন্য ফসল বাদ দিয়ে আখ চাষ বাড়াচ্ছেন। হঠাৎ করে পাবনা চিনিকল বন্ধ হওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন।


বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের মহাসচিব এবং পাবনা জেলা আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী ওরফে পেপে বাদশা বিবার্তাকে বলেন, কৃষকদের স্বার্থে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য বন্ধ মিল চালু করা দরকার। তা-না হলে এসব মিলের সঙ্গে যুক্ত কৃষকরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফলে, দেশিয় চিনি উৎপাদন বড় ধরনের সংকটে পড়বে। চিনির বাজার পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।


তিনি আরও জানান, দেশে বিমান, রেলওয়ে, তাঁতশিল্পে তো লোকসানে আছে। সেগুলো তো বন্ধ হচ্ছে না! ওইসব সেক্টরের তুলনায় সামান্যই লোকসান চিনিকলে। তারপরও চিনিকলের মোট স্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সে টাকার বার্ষিক ৪ শতাংশ মুনাফা ধরলেও বছরে বাড়ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে চিনিকলকে অলাভজনক বলা যাবে না। পাবনাসহ দেশের ছয়টি মিল বন্ধ করে দেওয়া হলো। এতে পাবনার আখচাষিরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তিনি বলেন, দেশে চিনিকল চালু আছে তাই আজও চিনির বাজার স্থিতিশীল। সব চিনিকল বন্ধ ঘোষণার পরদিন থেকেই চিনির দাম চারগুণ বেড়ে যাবে।


পাবনা জেলা আখচাষি কল্যাণ সমিতির এই নেতা আরও বলেন, পাবনা চিনিকল আবার চালু করতে কৃষক-শ্রমিক-কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে রয়েছেন। করোনার কারণে তাদের আন্দোলন ব্যাহত হয়েছে। তবে তারা তাদের পাঁচ দফা দাবিতে অটল বলে জানান তিনি। ৫ দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলাদেশের সব চিনিকলে আখ মাড়াই করতে হবে। বকেয়া বেতনসহ শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের সব পাওনা পরিশোধ করতে হবে, কৃষক পর্যায়ে সার-কীটনাশকসহ সব উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।


পাবনা চিনিকলের সাবেক বেশ কিছু কর্মচারী জানান, তাদের দেশের বিভিন্ন চিনিকলে সংযুক্ত করা হচ্ছে। এতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনেকে সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বদল করতেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।


পাবনার দাশুড়িয়ার কালিকাপুর গ্রামের মিন্টু হোসেন বিবার্তাকে জানায়, আখ চাষ ছিল সহজ পদ্ধতি। অল্প পরিশ্রমে বেশি টাকা আয় করা সম্ভব ছিল। আর আমাদের এই পাবনা সুগার মিলটি ছিল অনেক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন মিল। সুগার মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমরা আর আখ চাষ করতে পারছি না। তেমন অনেকেই যারা মৌসুম ভিত্তিক সুগার মিলে চাকরি করতেন, তারাও চাকরি হারিয়েছেন।


এ বিষয়ে পাবনা সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বিবার্তাকে জানায়, এই মিলের মাড়াই বন্ধের পর মিলটিতে কর্মরত অধিকাংশ স্থায়ী ও মৌসুমভিত্তিক স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের অন্যান্য চিনিকলে বদলি করা হয়েছে। আগামীতেও সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক মিলের কার্যক্রম চলবে। আর বর্তমানে পাবনা সুগার মিলে যে সকল যন্ত্রাংশ আছে অন্যান্য মিলে সেই যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হলে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে সেই মিলে পাঠানো হচ্ছে। বর্তমানে মিলটিতে ৫৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন৷ প্রতিমাসে বেতন দিতে হয় ১১ লাখ টাকা। তিনি আরো বলেন, আমরাও চাই পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থানে আখ চাষে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠুক ।


এ বিষয়ে পাবনা- ৪ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, পাবনা চিনিকল বন্ধের পেছনে দায়ী করপোরেশনের কর্মকর্তারা। করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে চিনিকলটি বন্ধ হয়েছে। চিনিকলটি চালু করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে- দেখা যাক তারা কি সিদ্ধান্ত নেয়।


বিবার্তা/রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com