শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির জট, ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা!
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২৩
শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির জট, ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর সেই মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর বলা হয় শিক্ষকদের। অথচ সেই শিক্ষকরাই কোণঠাসা! বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) এর সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও দীর্ঘ সময়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন না তারা। ফলে বছরের পর বছর এক পদেই ঘুরপাক খাচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগররা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলছেন, যেখানে অধিকাংশ ক্যাডার সার্ভিসে পদোন্নতি হচ্ছে, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের না হওয়া সত্যিই খুবই হতাশার। শিক্ষাবিদরা বলছেন, মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতায় আসতে চাচ্ছে না। এই পেশায় পদোন্নতি না হওয়ার


সমস্যা তাদেরকে আরও অনাগ্রহী করে তুলবে। কাজেই অবিলম্বে শিক্ষা ক্যাডারের এই সমস্যা দূর করে সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা উচিত।


তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, বিসিএসের ১৬ থেকে ৩৫তম পর্যন্ত ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা সব ধরনের যোগ্যতা অর্জন করলেও প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ শিক্ষা ক্যাডারের শুরুর প্রভাষক পদ থেকে ধাপে ধাপে তাদের সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। সর্বশেষ ১৪ ও ১৫তম বিসিএসের বেশিরভাগ কর্মকর্তা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এরপর থেকেই লেগে আছে জট। যত দিন যাচ্ছে ততই সঙ্কট বেড়েই চলেছে। এরমধ্যে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ৩৫তম বিসিএস ব্যাচ পর্যন্ত ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। এর সঙ্গে ৩৬তম ব্যাচ থেকে চলতি সেপ্টেম্বর মাসে পদোন্নতিযোগ্য হয়ে এখন এই সংখ্যা ৩ হাজার। আর সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতিযোগ্য ৩ হাজার শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার জন।


এই বিষয়ে ১৬তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব সহযোগী অধ্যাপক রেহেনা খাতুন বিবার্তাকে বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের হতাশার কথা কী আর বলব? আমাদের ব্যাচের ৩৫৮ জন সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে এখনো পঞ্চম গ্রেডে রয়েছেন। এরমধ্যে অনেকে অধ্যাপক না হয়ে অবসরেও চলে গেছেন! এটা একজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের জন্য কতটা কষ্টের ও হতাশার, সেটা কেবল ভুক্তভোগী বলতেই পারবেন।


তিনি বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের দ্রুত পদোন্নতি দেয়া না হলে, আমাদের ব্যাচের ৫৬ জন চলতি বছরের ডিসেম্বরে আর ১২৭ জন আগামী বছর অধ্যাপক না হয়ে অবসরে চলে যাবেন। এটা ভাবা যায়? এটা শুধু এক ব্যাচের কথা বললাম, আরো ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত আছেন। কাজেই এই সংকট অতিদ্রুত সমাধান করা উচিত। তাহলে মানুষ গড়ার কারিগররা কাজে স্পৃহা পাবেন।


বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ২৫তম ব্যাচের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের বিবার্তাকে বলেন, পদে পদে শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরতরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই দায় কার? একই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বন্ধু-সহকর্মীরা কত উপরের গ্রেডে চলে যাচ্ছে। আর আমাদের কী হচ্ছে? কারো কারো তো অধ্যাপক হওয়ার আগে অবসরে যেতে হচ্ছে! এই পরিস্থিতি হলে মেধাবীরা ভবিষ্যতে এই পেশায় আসতে চাইবে কেন?


বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ২৮তম ব্যাচের সাধারণ সম্পাদক মো. তানভীর হাসান বিবার্তাকে বলেন, এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে শূন্য পদ বিবেচনার প্রয়োজন পড়ে না। সেখানে একজন শিক্ষক তার চাকরির ৮ বছরে ৫০ শতাংশ হারে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে থকেন। অথচ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা শূন্য পদের অজুহাতে ১০ থেকে ১২ বছরেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এটা কোনোক্রমেই যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। তাছাড়া প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে পদের চেয়েও দুই-তিনগুণ বেশি পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু আমরা যোগ্য হওয়ার পরও পদোন্নতি মিলছে না। এতে কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যায়।


এদিকে বিসিএসের ১৬তম ব্যাচ থেকে ৩৫তম ব্যাচ পর্যন্ত ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা সব যোগ্যতা অর্জন করেও বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি না হওয়ার ঘটনায় শিক্ষা সচিব সোলেমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গত ৩১ আগস্টের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি’। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের এই দাবি পূরণ না হওয়ায় মঙ্গলবার , ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পদোন্নতির জটিলতা নিরসন, নতুন পদ সৃষ্টি, পে-স্কেল সমস্যার সমাধানসহ শিক্ষা ক্যাডারে নানা বৈষম্য দ্রুত নিরসনের দাবি ফের জানিয়েছে সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকদের এই সংগঠন। এই সংবাদ সম্মেলনে দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সমিতির নেতারা।


এই বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, পদোন্নতিতে জটিলতা, নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়া, অর্জিত ছুটি না দেয়া, নতুন পে স্কেলের সমস্যা সমাধান না হওয়াসহ নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। না হলে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবো।



তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৪৪৪টি পদ সৃজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু, দীর্ঘ ৯ বছরেও এ পদগুলো সৃজন হয়নি। ফলে, দিন দিন বাড়ছে শিক্ষকদের নানা সংকট। অন্যান্য ক্যাডারে চাকরির ৫ বছর পূর্তিতে নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডারে তা দেয়া হচ্ছে না। অনেকেই একই পদে ৮ থেকে ১৩ বছর ধরে কর্মরত। পদোন্নতি না হওয়ায় অনেকে সামাজিকভাবে অমর্যাদাকর অবস্থায় পড়ছেন।


সমিতির মহাসচিব মো. শওকত হোসেন মোল্যা বিবার্তাকে বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করা হলেও বিশেষায়িত পেশা হিসেবে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারকে গড়ে তোলা হয়নি। উল্টো এ পেশাকে গ্রাস করছে অনভিজ্ঞ অপেশাদার। শিক্ষা ক্যাডারকে অবকাশমুক্ত করা জরুরি। শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির গতি খুবই শ্লথ। এটাকে এখনই ঠিক করা উচিত।


ক্যাডার সমিতির নেতারা বলছেন, শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতিযোগ্য সকল কর্মকর্তার পদোন্নতি দিলে সরকারের বছরে অতিরিক্ত খরচ হবে ৮৮ লাখ টাকা। কারণ, দীর্ঘদিন পদোন্নতি আটকে থাকায় বেশির ভাগ কর্মকর্তার মূল বেতন এখন পরের পদোন্নতি গ্রেডের সমান বা বেশি হয়ে গেছে। পদোন্নতি দিলেও সরকারের ব্যয় তেমন বাড়বে না। এদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, অবিলম্বে শিক্ষা ক্যাডারের এই সমস্যা দূর করে সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা উচিত।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, এমনিতেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশা তেমন নিতে চায় না, এখন যদি এই সংকটগুলো সামনে আসে, তাহলে তারা আরও অনাগ্রহী হবে। এক্ষেত্রে মূল কথা হলো- শিক্ষকতার মূল্যায়নটা সামাজিকভাবে আমরা সেভাবে করতে পারেনি। শিক্ষকদের বেতন ভাতাও আমরা কম দেই। অন্যান্য সেক্টর থেকে এই সেক্টরে শিক্ষকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও কম।



তিনি বলেন, আসলে সত্যিই বলতে, শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চ সম্মানের পেশা করা উচিত ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিগতভাবেও তাদেরকে খুব মর্যাদা দিতেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে আমরা শিক্ষকদের সেভাবে মর্যাদা দিতে পারিনি, যেটা আমাদেরই ব্যর্থতা। এটা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং যারা এই পেশায় আসবে তাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা অর্থাৎ তাদের বেতন-ভাতা, পদোন্নতিসহ অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।


পদোন্নতি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বিবার্তাকে বলেন, এই সংকট কাটাতে ইতোমধ্যে দুই দফা বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পদোন্নতির বিষয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ করছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে পদোন্নতি দেয়া হবে।


শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয় অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্যাডার সার্ভিসের নীতিমালা রয়েছে। আর সেই নীতিমালা অনুযায়ী তাদের আন্দোলনের সুযোগ নেই, আর এটি উচিতও নয়।


বিবার্তা/রাসেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com