৪০তম বিসিএস নন ক্যাডারে চাকরিপ্রত্যাশীদের অপেক্ষা আর কত?
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১০:৪১
৪০তম বিসিএস নন ক্যাডারে চাকরিপ্রত্যাশীদের অপেক্ষা আর কত?
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

কতটা পরিশ্রম আর কষ্টের পর একজন চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থী বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএসের) প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, রিটেন পরীক্ষা এবং ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়, এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন, যারা এ পথে হেঁটেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও অনেকে পাস করে বিসিএসের ক্যাডার পদ পান না। ফলে তারা নন ক্যাডারের আওতার মধ্যে থাকেন।


পরবর্তীতে তাদের থেকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ( পিএসসি) প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নানা পদে সুপারিশ করত। এটাই পিএসসির নিয়মে পরিণত হয়েছিল।


কিন্তু হঠাৎ করে পিএসসি তাদের নন ক্যাডারের সুপারিশের নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে, যা নিয়ে নন ক্যাডার চাকরি প্রত্যাশীদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও পিএসসি বলছে আগেও এই নিয়ম ছিল, কিন্তু তা দীর্ঘদিন মানা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের বেলায় এই বিধি আসায় বিপাকে পড়েছি ৪০ বিসিএসে নন ক্যাডারে চাকরিপ্রত্যাশীরা। এদিকে নতুন এই বিধির কারণে ৪০ বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলের পর ১৫ মাস হতে চললেও এখনও নন-ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়নি। কবে সুপারিশ করা হবে সে বিষয়েও আমরা কিছু জানি না।


৪০ তম বিসিএসে পাস করা নন ক্যাডার প্রত্যাশী চাকরিপ্রার্থী শাহরিয়ার বিবার্তা২৪ডটনেটকে এসব কথা বলেন।


৪০তম বিসিএসে নন ক্যাডারে চাকরিপ্রত্যাশী হাসিবুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ৪০তম বিসিএসের রেজাল্টের পর পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনকে জানিয়েছি বিগত বিসিএসগুলোর মতো আমাদের অনেককে নন ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হবে। কিন্তু এখন পিএসসির নতুন নীতিমালার কারণে আমরা যদি সুপারিশ বঞ্চিত হই, তাহলে সমাজে কেমনে মুখ দেখাবো ? এদিকে আমাদের অনেকের হয়তো এটাই শেষ বিসিএস ছিল। কাজেই তারাও যদি নন ক্যাডার থেকে কোন কিছু না পায়, তাহলে তারাও চরম হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। এদিকে ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলের পর ১৫ মাস হতে চললেও এখনো নন ক্যাডার বিধির সুরাহা হয়নি। ফলে হতাশায় দিনাতিপাত করছি চাকরিপ্রত্যাশীরা।


৪০তম বিসিএসে পাস করে ক্যাডার না পাওয়া চাকরিপ্রত্যাশী আরাফাতুল ইসলাম আবির বিবার্তাকে বলেন, সরকারি কর্ম কমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদফতরের অধিযাচনের ভিত্তিতে প্রাপ্ত নন-ক্যাডার শুন্য পদে সুপারিশ করে থাকে। চলমান বিসিএস নন-ক্যাডার সুপারিশপ্রক্রিয়া পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করার পূর্ব পর্যন্ত চলমান ছিল। ২৮তম বিসিএস থেকে ৩৮তম বিসিএস পর্যন্ত এই নিয়মেই পিএসসি নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ করে আসছে। ৩৮তম বিসিএস থেকে প্রায় ৩,৩০২ জন চাকরিপ্রার্থীকে বর্তমান কমিশনই এই নিয়মে নিয়োগ দেয়। কিন্তু, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার সুপারিশের এই নিয়মে পরিবর্তন এনেছে। এখন থেকে নন-ক্যাডার সুপারিশ করা হবে বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তির তারিখ অনুযায়ী। অর্থাৎ কোন বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সরাসরি বিসিএস থেকে নিয়োগযোগ্য নন-ক্যাডার শুন্য পদ সংরক্ষণ করে সংখ্যা উল্লেখপূর্বক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পিএসসিতে পাঠাতে হবে এবং পিএসসি ঐ বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তিতে সেই নন-ক্যাডার পদগুলো উল্লেখ করে পরবর্তীতে উত্তীর্ণ নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করবে। এর ফলে বর্তমানে নন-ক্যাডারদের জন্য চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।


নন ক্যাডার চাকরি প্রত্যাশী বেলাল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগের জন্য যদি বিজ্ঞপ্তির তারিখ অনুযায়ী বিভাজন করা হয়, তাহলে উত্তীর্ণ ৮,১৬৬ জন মেধাবী চাকরিপ্রার্থীর অধিকাংশ প্রার্থী সুপারিশ বঞ্চিত হবে। কারণ ৪০তম বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ১১.০৯.২০১৮ তারিখে এবং উক্ত তারিখ পর্যন্ত যত শুন্য পদ ছিল তার প্রায় সব পদেই ৩৭তম বিসিএস ও ৩৮তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি ৪০তম বিসিএস এর চূড়ান্ত রেজাল্ট প্রকাশের আগের দিন অর্থাৎ ২৯.০৩,২০২২ তারিখে ও ৩৮তম বিসিএস এর প্রার্থীদের ৩৩৭ টিপদে সুপারিশ করা হয়েছে।এখন সেই হিসেবে উক্ত তারিখ পর্যন্ত শুন্যপদে সুপারিশ করতে চাইলে আমাদের জন্য পদ নাই বললেই চলে।


তিনি বলেন, করোনার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০তম বিসিএসের প্রার্থীরা। কয়েক দফায় ভাইভা স্থগিত এবং ৪০তম বিসিএস এর মাঝে ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান থাকায় সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ৪০তম বিসিএস । এই বিসিএস এর নিয়োগ প্রক্রিয়া ৪ বছর পেরিয়ে ৫ বছরে পড়ায় আমাদের অধিকাংশ প্রার্থীর সরকারি চাকুরির বয়স শেষ। তাই, নন-ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রে তারিখওয়ারী বিভাজন করলে আমরা সুপারিশ বঞ্চিত হব।


এদিকে নন ক্যাডারে চাকরিপ্রত্যাশীরা নতুন নীতিমালার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলনেও নেমেছেন। ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে তাদের এই আন্দোলন শুরু হয়। নন-ক্যাডার নিয়োগে পূর্বের নিয়ম বহালসহ ছয় দফা দাবি নিয়ে পিএসসির সামনে লাগাতার অবস্থান, একই বছরের ৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদসহ টানা ১৫তম দিনের কর্মসূচি পালন করেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। পরে একই বছরের সোমবার (২০ নভেম্বর) ৪০তম বিসিএস উত্তীর্ণ নন-ক্যাডারে চাকরিপ্রার্থীদের চলমান আন্দোলন কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। তখন পিএসসি আন্দোলনকারীদের দাবির বিষয়ে ইতিবাচক না হলে ফের কঠোর কর্মসূচির কথা জানান চাকরিপ্রার্থীরা।




এদিকে, আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীদের দাবি আইনগত ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্বে যেভাবে নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেটি আইনগতভাবে সঠিক হয়নি। কেননা, প্রতিটি বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারের পদসংখ্যা উল্লেখ করে দিতে বলে গেজেটে বলা হয়েছে। এতদিন সেই আইন অমান্য করা হয়েছে। তারা এই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চান না।



জানা যায়, ৪০তম বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের ৩০ মার্চ। এর প্রায় ৩ মাস পর পিএসসি ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার পদের জন্য অনলাইন আবেদনপত্র আহ্বান করে অর্থাৎ একই বছরের জুন মাসের ২৬ তারিখ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার হতে সুপারিশ করার লক্ষ্যে শুন্যপদের অধিযাচন/রিকুইজিশন চেয়ে পত্র ইস্যু করে। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ৪০তম বিসিএস ফরমেটে পিএসসিতে নন-ক্যাডার শুন্যপদের অধিযাচন পাঠানো হয়। হঠাৎ করে একই বছরের ২৩ আগস্ট তারিখে পিএসসি থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪ তমবিসিএসের বিজ্ঞপ্তির তারিখওয়ারী ৪০তম বিসিএসের জন্য আসা সব নন-ক্যাডার শুন্যপদ বিভাজন করে সেই অনুযায়ী পদগুলো পিএসসিতে পাঠানোর জন্য পিএসসি পত্র প্রেরণ করে।


এই চিঠির বিষয়ে ৪০তম বিসিএসের নন ক্যাডারের চাকরিপ্রত্যাশীরা বলেন, এতোদিন ধরে আমরা সুপারিশের অপেক্ষায় আছি। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের ৬ মাস পরে এসে এরকম সিদ্ধান্ত নিলে ৪ বছর ধরে অপেক্ষাকরে ১৫০০ নম্বরের দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকুরি না পেয়ে আমরা এবং আমাদের পরিবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বো।


সূত্র জানায়, বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০১০ সালের বিধি ২০১৪ সালে সংশোধন করা হয়েছে। বিধিতে বলা আছে, বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডারের পাশাপাশি নন-ক্যাডার শূন্য পদের বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ২৮তম থেকে ৪৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার শূন্য পদের বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য সরকার বিধি সংশোধন করে ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত নন-ক্যাডার নিয়োগের বৈধতা দিয়েছিল। এখন একইভাবে ৩৫তম থেকে ৪৪তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগের বৈধতা দেয়ার চিন্তা করছে সরকার। এটি করা হলে আবার বিধি সংশোধন করতে হবে। তাহলে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করা যাবে। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে পিএসসি মতামত দিয়েছে। এখন তা যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হবে।


পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৩৪তম বিসিএসে মোট নন-ক্যাডার প্রার্থী ছিলেন-৬৫৮৪ জন। এরমধ্যে নন-ক্যাডারে সর্বমোট সুপারিশপ্রাপ্ত- ১৮০২ জন। ৩৫তম বিসিএসে মোট নন-ক্যাডার প্রার্থী ছিলেন৩৩৫৯ জন। এর মধ্যে সর্বমোট নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত - ২১৪৪জন। ৩৬তম বিসিএসে মোট নন-ক্যাডার প্রার্থীছিলেন ৩৩০৮ জন। এর মধ্যে সর্বমোট নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত-১২৬১ জন। ৩৭তম বিসিএসে মোট নন-ক্যাডার প্রার্থী-৩৪৫৪ জন, এর মধ্যে সর্বমোট নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত-১৭২৪ জন।৩৮তম বিসিএসে মোট নন-ক্যাডার প্রার্থী ছিলেন -৬১৭৩ জন, এর মধ্যে সর্বমোট নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত-৩৩০২ জন। ৪০ বিসিএসে নন ক্যাডারে অপেক্ষামান প্রায় ৬০০০ প্রার্থী থাকলেও ১৫ মাসেও কাউকে সুপারিশ করতে পারেনি পিএসসি।



৪০তম বিসিএসের নন ক্যাডার নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষা শাখা (নন-ক্যাডার) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবদুল্লাহ আল মামুন বিবার্তাকে বলেন, আপনি এই বিষয়ে ক্যাডার শাখার সাথে কথা বলুন।



পরে এই বিষয়ে পিএসসির পরীক্ষা শাখার (ক্যাডার) পরিচালক মো. নেয়ামত উল্যাহ বিবার্তাকে বলেন, এই বিষয়ে কথা বলার ইখতিয়ার আমার নয়। আপনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সাথে যোগাযোগ করুন।


পরে এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আনন্দ কুমার বিশ্বাসকে একাধিকবার কল দিলেও তার মুঠোফোন নাম্বারটি ব্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।


নতুন নন ক্যাডার বিধি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বিবার্তাকে বলেন,এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। বিধি সংশোধনের বিষয়ে পিএসসি তার মতামত দিয়েছে। এখন অবশিষ্ট কাজ মন্ত্রণালয়ের। তবে এই বিষয়ে আমরা সব সময় খোঁজ খবর রাখছি।


তিনি বলেন, চাকরিপ্রার্থীদের হতাশ না হয়ে আর কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে। আশা করছি খুব শিগগিরই বিধি সংশোধন হয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com