বইমেলায় কমেছে বিক্রি, কী বলছেন আয়োজক-প্রকাশকরা?
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৩, ২০:০৩
বইমেলায় কমেছে বিক্রি, কী বলছেন আয়োজক-প্রকাশকরা?
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ এর পর্দা নেমেছে ২৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। মাসব্যাপী চলা বাঙালির প্রাণের মেলায় এবার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও কমেছে বিক্রি। গত বছরের তুলনায় বই বিক্রি কমেছে প্রায় ৫ কোটি টাকার। প্রকাশকরা বলছেন, নানা কারণে কমেছে বই বিক্রি। তারা বলেছেন, বৈশ্বিক সংকটেও বাংলা একাডেমি তাদের কোন সহায়তা করেনি!


মাসব্যাপী মেলা শেষে মঙ্গলবার রাতে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ থেকে বলা হয়, এবার মোট ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিক্রি কমেছে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এদিকে বিক্রি কমেছে খোদ বাংলা একাডেমিরও। আগের বছরের চেয়ে ১০ লাখ টাকা কম বিক্রি হয়েছে সংস্থাটির। গত বছর তাদের বিক্রি ছিল ১ কোটি ৩৪ লাখ, এবার তা ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা।


এবারের বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৫০টি, যা আগের বছর ছিল ৩ হাজার ৪১৬টি। অর্থাৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে।


মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানে মেলার সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের বইমেলায় একত্রিশ দিনে বাংলা একাডেমি বই বিক্রি করেছে মোট ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকার। আর এবার ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি বই বিক্রি করেছে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকার। ২০২২ সালের বইমেলায় সর্বমোট বই বিক্রি হয় ৫২ কোটি টাকার। কিন্তু এবার ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।


এবারের বইমেলায় প্রকাশিত বইসংখ্যা নিয়ে তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত মেলায় ঘোষণা মঞ্চের তথ্য অনুযায়ী মেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৫০টি, যা গতবছর ছিল ৩ হাজার ৪১৬টি। অনেক প্রকাশক তাদের নতুন বইয়ের নাম না দেয়ায় মোট সংখ্যা কিছুটা এদিক সেদিক হতে পারে।


বই বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রকাশকরা বলছেন, নানা কারণে কমছে বই বিক্রি। বৈশ্বিক সংকটের কারণে কাগজের দামসহ বইয়ের সরঞ্জামের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বইয়ের দামও বেড়েছে। তাছাড়া অনলাইনে বই বিক্রি হওয়ায় মেলায় বিক্রি কমেছে বলে দাবি তাদের।



বই বিক্রি কম হওয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলা জার্নাল এর প্রকাশক হাবিবুর রহমান রোমেল বিবার্তাকে বলেন, যে কোনো কারণেই হোক আমরা পাঠবিমুখ হয়ে গেছি। মানুষ পড়ার চর্চার মধ্যে নেই। আমাদের পড়ার চেয়ে খাওয়ার চর্চা অনেক বেশি হচ্ছে। আপনি দেখবেন, বইমেলায় যে কটা কফিসপ বা খাবার স্টল আছে- তাদের ইন্টারভিউ নিয়ে দেখেন, একটা কফিসপে শুক্র-শনিবার বাদে ১২০০-১৫০০ কাপ কফি বিক্রি হচ্ছে। আর শুক্রবার-শনিবারে এটা ২৫০০-৩০০০ কাপ পর্যন্ত ঠেকে। একইভাবে খাবারের দোকানগুলোতে গেলে বেচাবিক্রির একই দৃশ্য দেখতে পাবেন। বাংলাবাজার বইয়ের মার্কেট বাদে আপনি আজিজে দেখেন কিংবা কনকর্ডসহ নানা জায়গায় দেখেন, আগে বইয়ের দোকান ছিল কিন্তু এখন বইয়ের দোকান নাই। ফলত এই যে, পাঠ্যভাস নাই- সেই কারণে বই বিক্রি হচ্ছে না কিংবা হলেও কম হচ্ছে।


তিনি বলেন, আজকে মেলার শেষদিনে দেখেন, কী পরিমাণ লোক সমাগম আছে। কিন্তু সবার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন শতকরা ৫ ভাগ লোকের হাতে কি একটা বইয়ের ব্যাগ কিংবা বই আছে?


প্রকাশকরা নানা সংকটেও বাংলা একাডেমির সহযোগিতা পায়নি জানিয়ে এই প্রকাশক বলেন, আপনি কলকাতা বইমেলাসহ অন্যান্য মেলা দেখেন, সেখানে মেলা আয়োজন করে প্রকাশকরা। কিন্তু বাংলাদেশে বইমেলার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। তবে এই বইমেলার আয়োজনের শুরুটা কিন্তু মুক্তধারার হাতেই হয়েছে। বাংলা একাডেমি তার লাভের চিন্তায় আছে। বৈশ্বিক সংকটে কী হয়েছে? কোন প্রকাশনী চলল, কোন প্রকাশনী চলল না! প্রকাশনীগুলোর কল্যাণে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা, এসব নিয়ে একাডেমির মাথাব্যথা নেই।


ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রকাশক বলেন, করোনাকালীন সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টর হচ্ছে পাবলিকেশন্স। গত দুই বছর করোনার মধ্যেও মেলা হয়েছে কিন্তু বই তো তেমন বিক্রি হয়নি। কিন্তু এইবার কাগজপত্র, কালি, বাইন্ডিং থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম যে পরিমাণ বেড়েছে, সেটা বিবেচনা করে বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আমি স্পষ্ট করে এটা বলতে চাই, ৮ ফুট বাই ৮ ফুট অর্থাৎ ৬৪ স্কয়ার ফিট একটা স্টলের উপরের টিন লাগানো আর জায়গার ভাড়া বাংলা একাডেমি করেছে ১৫,১৮০ টাকা! ভাবা যায়?


জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ডা. রাজিয়া রহমান জলি বিবার্তাকে বলেন, আমাদের ধারণা ছিল কোভিডের পরবর্তীতে এই বছরের বইমেলা খুব ভালোভাবে যাবে কিন্তু শুরুতেই আমরা ধাক্কা খেলাম বৈশ্বিক সংকটের কারণে কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়। আর এই কারণে মনে হয় এবারের বইমেলায় বিক্রিটাও কম। কারণ, কাগজের দাম বাড়াতে আমাদের প্রডাকশন কষ্ট অনেক বেশি ছিল। শুধু তাই নয়, কাগজের সাথে সাথে বাইন্ডিং এর পারিশ্রমিকও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বইয়ের দাম বেশি রাখতে হয়েছে।


তিনি বলেন, এবার বাংলা একাডেমির কাছে প্রকাশকদের প্রত্যাশা ছিল যাতে স্টল ভাড়া একটু কম রাখা হয়। কিন্তু তা রাখা হয়নি। এক ইউনিট যেখানে ১৫ হাজার টাকা, সেখানে আমার থেকে তিন ইউনিটের জন্য ৪৫ হাজার নিতে পারত। কিন্তু আমার কাছ থেকে তিন ইউনিটের জন্য নেয়া হলো ৬০ হাজার টাকা। এখানে এতো বেশি রাখা হলো কেন?


নালন্দা প্রকাশনীর প্রকাশক রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল বিবার্তাকে বলেন, অমর একুশে বইমেলায় বই বিক্রি কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, এখন অনলাইনে বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। কারণ, ডিজিটাল এই যুগে অনলাইনে অর্ডার করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বই নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে অনেকে বইমেলায় এসে গ্যাদারিং সহ্য করে বই কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাছাড়া এখানে আসতে যাতায়াতসহ আরও নানা খরচ হয়। ফলে তারা অনলাইনে পছন্দের বই অর্ডার করে থাকেন।


এই প্রকাশক বলেন, প্রযুক্তির এই যুগে মানুষও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকে বই না কিনেও অনলাইন থেকে পড়ে নিচ্ছেন। সামনের থেকে বইমেলা বই বিক্রি আরও কমবে আশঙ্কা করেন এই প্রকাশক।



শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবীন আহসান বলেন, বই বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে করোনার পরবর্তী সময়ে মানুষ পেপারের বই কম পড়ছে অর্থাৎ মানুষ মোবাইল-ইন্টারনেট চর্চার মধ্যে ঢুকে গেছে। আর এখান থেকে তাদের সহজে বের করাও সম্ভব নয়। একটা বিষয় দেখুন- প্রচুর মানুষ মেলায় আসছে ঠিকই কিন্তু প্রচুর মানুষ বই কিনছে না! একদিকে বিগত দুই বছরে মানুষ করোনার কারণে বের হতে পারেনি অন্যদিকে এবার বৈশ্বিক যুদ্ধের কারণে ঊর্ধ্বগতিও অধিকাংশ মানুষকে ভোগাচ্ছে! ফলে যেখানে চাল, ডাল, লবণ কিনতে মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে বই কিনতে যাবো কেন?


তিনি বলেন, আমরা বাংলা একাডেমিকে বারবার বলেছি যে- মেলায় টিকিটের ব্যবস্থা করা হোক। আর এই টাকা দিয়ে আমরা যে অনেক টাকা দিয়ে স্টল ভাড়া নিয়ে থাকি সেটাকে অর্ধেকে নামিয়ে দেয়া যেতে পারে। মেলায় টিকিটের ব্যবস্থা করা হলে শৃঙ্খলাও থাকবে। আর এর মাধ্যমে কত মানুষ মেলায় ঢুকল তার একটা পরিসংখ্যানও পাওয়া যাবে।


পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের প্রকাশক রুম্মান বিবার্তাকে বলেন, বিগত দুই বছর বৈশ্বিক মহামারীর কারণে প্রকাশকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশকরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বিধিবাম! এবারও বৈশ্বিক সংকটের কারণে কাগজের দাম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আমাদের অনেকে যে পরিমাণ বই ছাপানোর কথা, সেটা করতে পারেননি। যা বই বিক্রি কমে যাওয়ার একটা কারণ। তাছাড়া বৈশ্বিক সংকটে অনেকে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছেন। ফলে ইচ্ছে থাকলেও বই কেনায় তাদের আগ্রহ কমেছে। যার কারণে বই বিক্রিও কম হয়েছে। আরেকটা বিষয় আমরা যতটুকু ইনভেস্ট করব, সেই আনুপাতিক হারে তো লাভ আসবে, এইদিকেও আমরা পিছিয়েছিলাম।


এবারের বইমেলায় বই বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, বই বিক্রির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য বাংলা একাডেমির প্রতিনিধিরা স্টলে স্টলে ফরম বিতরণ করেছেন। কিন্তু অনেক স্টল/প্যাভিলিয়নের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। এদিকে প্রচারণায় এগিয়ে থাকা অনেক স্টল কিংবা প্যাভিলিয়নের তথ্যে গরমিল থাকতে পারে। ফলে এটি বইমেলার পূর্ণাঙ্গ বিক্রির হিসাব তা পরিচালনা কমিটি মনে করে না। তবে বৈশ্বিক সংকটের কারণে কাগজসহ নানা সরঞ্জামের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার বইয়ের দামও বেড়েছে। ফলে এই কারণেও বিক্রি কমতে পারে।


নানা সংকটে থেকেও প্রকাশকরা একাডেমি থেকে কোন সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, দেখুন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তারপরেও কিছুটা সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। এবার কী কী দূর্বলতা ছিল, তা পরিচালনা কমিটির সাথে আলোচনা করে পরবর্তীতে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসএ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com