স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অভিযোজন নাকি পেশাগত দ্বন্দ্ব?
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৩, ২২:৪০
স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অভিযোজন নাকি পেশাগত দ্বন্দ্ব?
রাশেদ হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+

‘স্যার’ শব্দ নিয়ে বিতর্ক আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত এবং বারংবার ঘটিত ঘটনা। এই বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা প্রায় সময় আমাদের দেশে সংবাদপত্রের খোরাক হয়ে ভেসে আসে কিংবা আমরা নিজেরাও এর সম্মুখীন হই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে।


কিছুদিন পূর্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ডাক্তার দেখানোর জন্য টিকেট কাটতে গেলাম। টিকেট কাটার পরবর্তী ধাপে দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে (নিশ্চিত চিকিৎসক না) ভাই বলে সম্বোধন করার পর তিনি আমার মুখের দিকে বিরক্তিসূচক ভঙ্গিমা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। নিজের কৃত অপকর্মের ভুল বুঝতে পেরে আমি দুঃখিত ‘স্যার’ বলে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। এই ‘স্যার’ শব্দ সম্পর্কিত ‘রংপুরের ডিসি বনাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সহযোগী অধ্যাপকের ঘটনা নিয়ে বর্তমানেও খুব আলোচনা সমালোচনা চলছে। আর এই লেখাটি হলো সেই ঘটনাকে দুটো প্রত্যয় যথা সাংস্কৃতিক অভিযোজন (Acculturation)  এবং পেশাগত দ্বন্দ্ব (Occupational Conflict) দিয়ে ব্যাখ্যা করার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস।


পূর্বেও এ ধরনের ঘটনা আমরা দেখতে পাই সংবাদমাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জার্নালের একটি সংবাদে দেখা যায় ‘স্যার’ না বলার কারণে মল্লিক সুধাংশু নামে একজন সাংবাদিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করে খুলনার তেরখাদা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লিটন আলী। একইভাবে ২০২১ সালের ১০ জুলাই ডিবিসি নিউজের এক সংবাদে দেখা যায়, মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লাকে আপা সম্বোধন করায় তপন চন্দ্র দাশ নামে এক ব্যবসায়ীকে লাঠিপেটা করা হয়। কেন এমনটা হচ্ছে? এটার একটা উত্তর আমাদের সংস্কৃতির প্রভাব যা দ্বান্দিক মতবাদ (Social-Conflict Approach) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।


সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বান্দিক মতবাদ (Social-Conflict Approach) যা সামাজিক অসমতা এবং বিদ্যমান সংস্কৃতির মধ্যেকার সংযোগকে গুরুত্ব দেয়। সমাজবিজ্ঞানী Macionis (২০১২) এর মতে, “Culture is a system that benefits some people and disadvantage others”. ঠিক একইভাবে আমাদের সমাজে বিদ্যমান সংস্কৃতি আমলাতন্ত্রের এই স্তরবিন্যাস কিংবা উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করে যা আমলাতন্ত্রের সাথে সমাজের অন্য শ্রেণি পেশার মানুষদের দূরত্ব তৈরি করে। আমাদের সংস্কৃতি আমলাতন্ত্রের সংস্কৃতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে প্রদর্শন করে।


জীবনের অনেক সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে, কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অবশেষে একজন সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে। কিন্তু কেন? এর অনেক কারণ হতে পারে। তার মধ্যে একটা কারণ, তার পূর্বের সংস্কৃতি তথা জীবনযাত্রার পরিবর্তে নতুন সংস্কৃতি চর্চা। নতুন এই সংস্কৃতি চর্চাকেই বলা হয় সাংস্কৃতিক অভিযোজন (Acculturation) যার মাধ্যমে এক সংস্কৃতির লোকজন অন্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত নিচুমানের সংস্কৃতি চর্চাকারীরা তাদের থেকে উন্নত মানের সংস্কৃতি গ্রহণ করে থাকে। তাহলে যখন স্যার বলে সম্বোধন করতে বলেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটা আমলাতান্ত্রিক কাঠামোটারই একটা ফলাফল।



‘স্যার’ শব্দটি আমাদের দেশে সাংস্কৃতায়নেরই (Acculturation) একটি উদাহরণ যা মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশকাল থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, ভারতে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে পরিচিত অশোক মিত্রের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করা একটি উদাহরণ টেনে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন। অশোক মিত্র সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষন শেষে একজন ব্রিটিশ উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে গিয়ে তাকে স্যার বলে সম্বোধন না করায় তার চেহারায় বিরক্তিভাব দেখতে পান কেননা সে উর্ধ্বতব কর্মকর্তা সম্মানসূচক সম্বোধন শুনতে অভ্যস্ত (৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১, বিবিসি নিউজ বাংলা)। অর্থাৎ এ স্যার শব্দটির শব্দগত সাংস্কৃতায়ন শুরু হয় ব্রিটিশ আমল থেকে।



সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার বলার কোন নীতি নেই বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন উল্লেখ করেন (৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, প্রথম আলো)। তারপর ও এ ধরণের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর কারণ আমলাতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পরিবর্তনের প্রতি বিমুখতা। হাবীব জাফরুল্লাহ (২০১৩) তাঁর “Bureaucratic Culture and the Social-Political Connection: The Bangladesh” প্রবন্ধে উল্লেখ করেন অন্যান্য আমলাতন্ত্রের মতোই বাংলাদেশেও আমলারা তাদের মর্যাদা, কার্যক্রমে,  কাঠামো, আচার আচরণে পরিবর্তন আনতে বিমুখ। এই সাংস্কৃতিক অভিযোজন কিংবা পরিবর্তনের প্রতি অনীহা থেকেই বারংবার এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।


তবে প্লেকার্ড নিয়ে এই অসঙ্গতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলনটা করা হলো সেটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন? অনেক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যেতে পারে। একটা দৃষ্টিভঙ্গি হলো পেশাগত যুদ্ধ (Occupational Conflict)। দুইটা পেশার মধ্যে বিদ্যমান ঠাণ্ডা যুদ্ধেরও একটা বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে এই ঘটনাকে। সমাজে এই দুই পেশার মানুষের মধ্যে এরকম অনেক ঠাণ্ডা যুদ্ধ দেখা যায়। কিছুদিন পূর্বে এক জন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সাথে কথা হচ্ছিলো। এক পর্যায়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার দিক নিয়ে কথা বললেন। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার কোন প্রায়োগিক দিক নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করেন আমলাদের হাতে সব ক্ষমতা চলে যাচ্ছে (এর তাত্বিক ব্যাখ্যাও রয়েছে)। অনেকাংশে আমলাতন্ত্রকে তাঁরা ঘৃণাও করেন। ক্লাস রুমে পড়াতে গিয়ে শিক্ষকরা প্রায় সময় আমলাতন্ত্রের দিকে শিক্ষার্থীদের প্রবল আগ্রহ কে সমালোচনা করার সহিত এর বিরুদ্ধে যে তাদের রাগ, ক্ষোভ রয়েছে তাও প্রকাশ করেন। এই পেশাগত দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয় মূলত ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের পর থেকে। সেই স্কেল অনুসারে যারা প্রশাসনে যোগদান করেছেন, তাঁরা হবেন সর্বোচ্চ প্রথম গ্রেডের বেতনভোগী, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হবেন সর্বোচ্চ তৃতীয় গ্রেডের বেতনভোগী (১৩ জানুয়ারী ২০১৬, প্রথম আলো)।


বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের লোকজনের প্রবেশও তাদের এই ঘৃণার আরেকটি কারণ। ২০২১ সালের ৫ মে  রাষ্ট্রপতির অনুমতিক্রমে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় যিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল ভোগরত) (দেশ রূপান্তর, ৮ মে ২০২১)। এই নিয়োগটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনভাবেই গ্রহণ করেন নি, প্রতিবাদ জানিয়েছেন ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি যা এই পেশাগত দ্বন্দ্বকেই স্পষ্ট করে তোলে।


একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আমলাদের এই পেশাগত দ্বন্দ্ব বিদ্যমান তা নয়। এই দ্বন্দ্ব প্রত্যেকটি পেশার, শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যমান। আমাদের সংস্কৃতিই আমাদের নিজস্ব পেশাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন করে প্রদর্শন করার শিক্ষা দেয়। ‘স্যার’ শব্দটি নেহাতই একটি সম্মানসূচক সম্বোধন। স্যার না বলে যদি অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করে সে সম্মানটা দেখানো যায় তাহলে মন্দ হয় না। মোদ্দা কথা সম্মানহানিকর শব্দ ব্যবহার না করাই যথেষ্ট।  একইভাবে পেশাগত যুদ্ধ পরিহার করে নিজ পেশার অসঙ্গতি যদি নিজ পেশার মানুষজন খুঁজে বের করতো তাহলে এই পেশাগত যুদ্ধ হয়তো কমে যেত।


লেখক : রাশেদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


(সহ-সভাপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com