সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যে একাকার রক্তদহ বিল
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:২৭
সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যে একাকার রক্তদহ বিল
পর্যটন ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

সবারই নজর কাড়ে। এই বিলের নাম শুনলেই হয়তো গায়ে কাঁটা দেয়! আবার অনেকেই ভাবতে পারেন, আসলেই কি বিলের পানির রং লাল না-কি! তাহলে এর নাম কেন রক্তদহ বিল?


আসলে এই বিলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পলাশী পরবর্তী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৭৮৬ সালে ফকির মজনু শাহের সঙ্গে এখানে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে সৈনিকদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল বিলের পানি। এরপর থেকেই বিলটির নামকরণ করা হয় রক্তদহ।


বগুড়া শহর থেকে এই বিলের অবস্থান ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহারে। রাণীনগরের পারইল এবং আত্রাই উপেজলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই বিলের অবস্থান। রক্তদহ বিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি অন্যতম বৃহৎ বিল।


বর্তমানে বছরে চার থেকে পাঁচ মাস পানি থাকে বিলটিতে। বর্ষা ও শরৎ ঋতুতে প্রায় ৯০০ একর আয়তনের এই বিল পানিতে থই থই করে। এ সময় রক্তদহ বিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ। নৌকায় হালকা ঢেউয়ে দোল খেতে খেতে ভেসে বেড়ান পর্যটকেরা। শীত ও গ্রীষ্মে কিছু অংশ ছাড়া এই বিল শুকিয়ে যায়। তখন শুকনা অংশে ইরি-বোরোর আবাদ হয়ে থাকে। রূপবদলের এই বৈচিত্র্যে শরতের রক্তদহ বিল সবচেয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে। স্থির জলরাশির দিকে তাকালে কখনো নীল আকাশ, গোধূলিলগ্নে ডুবন্ত রক্তিম সূর্য, আবার কখনো সাদা মেঘের ভেলার দেখা মেলে। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সাজ। তাই রক্তদহ বিলে নিরাপদে নৌকাভ্রমণের জন্য শরৎই শ্রেষ্ঠ সময়। নওগাঁর রানীনগর ও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার যেকোনো অংশ থেকে নৌকা নিয়ে ভেসে যাওয়া যায় বিলের গভীরে।


গল্পটা ব্রিটিশ আমলের। কোনো এক ব্রিটিশ সাহেব ও স্থানীয় জমিদারের অত্যাচারে কৃষকেরা ফুঁসে উঠেছিলেন। দানা বেঁধে উঠেছিল কৃষক বিদ্রোহের। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফকির মজনু শাহ। এই খবর গেল জমিদারের কানে। জমিদার ব্রিটিশ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহ দমনে নওগাঁর রানীনগর ও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার বিল ভোমরা এলাকার কড়ইল জঙ্গলে অভিযান চালান। ব্রিটিশ শাসক ও জমিদারের বাহিনী ধরে ফেলে বিদ্রোহীদের। তারপর এই বিলের ধারে নিয়ে একে একে হত্যা করা হয় তাঁদের। বিদ্রোহী মানুষদের তাজা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল বিলের পানি। বিলের সেই রক্তরাঙা পানির কারণে লোকমুখে এই বিলের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘রক্তদহ বিল’!


কাছাকাছি তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ ও রানীনগর উপজেলা সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য বাতায়নে। এখানকার সূত্র বলছে, বাংলায় ইংরেজ শাসক ও জমিদারদের প্রজাশোষণ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, ঠিক সে সময় ১৭ শতাব্দীর শেষের দিকে নওগাঁর রানীনগর ও বগুড়ার আদমদীঘি এলাকায় ফকির মজনু শাহের আগমন ঘটে। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন সন্নাসীরাও। সে সময় আদমদীঘির অধিকাংশ এলাকা ছিল গহিন অরণ্যাবৃত।


ফকির–সন্ন্যাসীরা এসব জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসে ইংরেজ শাসক ও তাঁদের এদেশীয় দোসর জমিদারদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করেন। জমিদার ও ইংরেজ সরকার তাঁদের দমন করার জন্য সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট আইনস্টাইনের নেতৃত্বে একটি বড় বাহিনী পাঠায়। এ সংবাদ পাওয়ার পর ফকির বাহিনীর সদস্যরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদমদীঘির কড়ই জঙ্গল এলাকায় সমবেত হন। এদিকে ইংরেজ সেনারা আত্রাই নদ হয়ে নৌকাযোগে বিল ভোমরা দিয়ে গোপনে কড়ই জঙ্গল ঘেরাও করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকেন। এ খবর পেয়ে মজনু বাহিনী এগিয়ে এসে বিল ভোমরায় তাদের বাধা দিলে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রচুর লোক হতাহত হওয়ায় বিলের পানির রং হয়ে ওঠে রক্তলাল। সেই থেকে বিল ভোমরা ঐতিহাসিক রক্তদহ বিল নাম ধারণ করে আছে। ওই যুদ্ধে মজনু শাহের একজন শীর্ষ সহযোগী শহীদ হন। তার মরদেহ ওই বিলে একটু উঁচু স্থানে দাফন করা হয়। ওই স্থান এখন ‘রক্তদহ দরগা’ নামে পরিচিত। সেখানে আছে প্রাচীন এক বটগাছ।


১৩টি খাল ও অন্যান্য জলপথ রক্তদহ বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মূল বিলটি ১০৫ হেক্টর হলেও বর্ষা ও শরতে এর ব্যাপ্তি প্রায় ৫০ কিলোমিটার হয়। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ১০০ একর এলাকায় সারা বছর পানি থাকে। একসময় রক্তদহ বিলের পরিচিতি ছিল দেশি মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে। এ বিলের বোয়াল, আইড়, গজার, পাবদা, ট্যাংরাসহ দেশি প্রজাতির নানান মাছের সুখ্যাতি আজও মানুষের মুখে মুখে। বিলের যেখানেই পানি, সেখানেই চোখে পড়বে মাছ ধরার ধুম। সোতিজাল, দোয়ার, চাঁই, বড়শিসহ বিভিন্ন মাছ ধরার যন্ত্র নিয়ে মেতে আছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ।


বিবার্তা/বিএম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com