চিম্বুক পাহাড় : সব হারিয়ে গেছে মেঘের নিচে!
প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৪, ০৮:৫৯
চিম্বুক পাহাড় : সব হারিয়ে গেছে মেঘের নিচে!
পর্যটন ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

পাহাড় বেয়ে চূড়ায় ওঠার সময় মাঝপথে থেকে নিচের দিকে তাকালে ফেলে আসা জনপদগুলোকে পিপিলিকার মতো মনে হয়। কেমন হবে যদি নিচে তাকিয়ে দেখা যায় সব হারিয়ে গেছে মেঘের নিচে!


শ্বেত শুভ্র পেঁজা তুলাগুলোকে আলগোছে পা ছুঁয়ে যাওয়াটাকে মোটেই পার্থিব মনে হবে না। বিশেষ করে বাংলাদেশি ট্রেকাররা হরহামেশা এরকম দৃশ্যের সম্মুখীন হন না।


কিন্তু বান্দরবানের এমন কিছু পাহাড় আছে, যেগুলো সত্যিকার অর্থেই এরকম অভিজ্ঞতার অবতারণা করতে পারে। ট্রেকাররা সুউচ্চ পাহাড়ের উপর আবিষ্কার করেন এক জাদুর নগরী। এগুলোর মধ্যে চিম্বুক পাহাড়ে উঠলে মনে হবে যেন সাক্ষাত দার্জিলিং।


চলুন, বাংলার দার্জিলিং চিম্বুক পাহাড় ট্রেকিংসহ ভ্রমণের বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।


চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের থানচিতে অবস্থিত এই পাহাড়টি স্থানীয় অনেকের কাছে কালা পাহাড় নামেও পরিচিত। বান্দরবান জেলা সদর থেকে জায়গাটির দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। গড় সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ফুট উঁচু এই প্রাকৃতিক বিস্ময় বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পাহাড়।


এই উচ্চতায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা ছাড়াও ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে অনায়াসেই দেখে নেওয়া যায় মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়গুলোকে। এ কারণে ঐতিহাসিক স্থানটি অনেক আগে থেকেই পর্যটকদের কাছে বাংলার দার্জিলিং হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে।


চিম্বুক পাহাড় ও এর আশেপাশে বসবাসরত নানা আদিবাসিদের মধ্যে ম্রো’রা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অনেক আগে থেকে এখানে তাদের ঘনবসতি থাকায় এখানকার পাহাড়সহ জংগল, গ্রাম, ও জুম ক্ষেতের নামে পাওয়া যায় তাদের ভাষার ব্যবহার।


ঠিক এই চিম্বুকের পাহাড়ী এলাকার আদি নিবাসী ছিলেন চিম্বক ম্রো। তার নামানুসারেই পাহাড়টি নাম পেয়েছে চিম্বুক। কিন্তু স্থানীয় ম্রো’দের মাঝে এটি এখনও ‘ইয়াং বং হুং’ নামে প্রচলিত। ম্রো ভাষায় ‘পাহাড়’ বোঝাতে ‘হুং’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।


এই পাহাড় চূড়া থেকে নিচের কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপজেলাগুলো দেখতে হলে আসতে হবে গরমের সময়ে। এ সময় কুয়াশা থাকে না বিধায় চারপাশ ও নিচের দৃশ্যগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। তবে গরমের সময় অতিরিক্ত তৃষ্ণা, হিট স্ট্রোক বা তাপদাহের কারণে অনন্য শারীরিক সমস্যা হতে পারে।


আর সেই মেঘের নগরী দেখতে হলে আসতে হবে বর্ষা ও শরতকালে। তবে জুন-জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মেঘগুলোতে শুভ্রতা বেশি। তাছাড়া মেঘের খুব কাছাকাছি হওয়াতে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপেও এখানে ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যায়। বর্ষা কালে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে রাস্তা পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত হয়ে থাকতে পারে। এছাড়াও ভূমিসরের কারণে রাস্তা সামিয়কভাবে বন্ধ থাকতে পারে।


শীতের মৌসুমেও পর্যটকরা চিম্বুক পাহাড়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারবেন। তবে গরম বা ঠান্ডা যে ঋতুই হোক না কেন, পূর্ণিমা রাতে পাহাড়ী চাঁদোয়া সব সময়ই আদিম ও অকৃত্রিম।


ভালো লাগাটা শুরু হবে একদম চিম্বুক যাওয়ার পথ থেকেই। রাস্তার দুই পাশের পাহাড়ে ধূসর ও সবুজ রঙের সামিয়ানা থেকে চোখ সরানোই দায়। সেগুলোর মাঝে শোভা ছড়াচ্ছে ম্রো’দের মাচার উপর বানানো ঘরগুলো। এই সর্পিলাকার পথটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সড়ক, যেটা ধরে এগোনোর সময় মনে হবে পৌছে যাচ্ছেন স্বর্গের দরজায়। পাঁকা এ সড়ক বেয়ে যে কোনও বাহনই তরতর করে উঠে যেতে পারে একেবারে চূড়ার কাছাকাছি। সবটা মিলে মনে হবে যেন সুপরিকল্পিত ভাবে আঁকা কোন ছবি।


সবুজের একঘেয়ে কাটাতে হঠাৎ হাজির হবে আসমানী রঙের সাঙ্গু নদী। একদম চূড়ায় দক্ষিণের দিকে এক সিঁড়ি নেমে গেছে বিশাল এক চত্বরে। এর নাম নব চত্বর, যেখানে কয়েক স্তরে সাজানো রয়েছে মনোরম কিছু ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকেই ১৮০ ডিগ্রীতে উপভোগ করা যায় পাহাড় ও আকাশের বিশালতা।


সিঁড়ির শেষপ্রান্তে পূর্ব ও পশ্চিম পাশে গাছের ছায়ায় রয়েছে কংক্রিটের সুদৃশ্য চেয়ার-টেবিল। শেষ বিকালে একান্তে সময় কাটানো বা আড্ডার জন্য এগুলো বেশ উপযুক্ত। একসঙ্গে হাজার লোক এলেও একই সময় তাদের সবাইকে জায়গা দিতে পারবে গোটা চিম্বুক।


পর্যটকদের কাছে চিম্বুকের আরও একটি আকর্ষণীয় দিক হলো- পাহাড়ের পাদদেশে বসা টাটকা পাহাড়ী ফলের বিপণী। আখ, শরিফা, ডাব, বরই ও কমলার মতো মৌসুমী ফলের পাশাপাশি পাওয়া যায় কলা ও পেঁপের মতো বার মাসী ফল।


এই জায়গাটায় মারমাদের বসবাস এবং বিপণীগুলোতে তাদেরকেই বেশি দেখা যায়। এছাড়া স্বল্প কিছু বার্মিজ ও অন্যান্য আদিবাসী পণ্যও দেখা যায়।


ঢাকা থেকে চিম্বুক যাওয়ার উপায়


চিম্বুকের অভিযাত্রীদের প্রথমেই যেতে হবে বান্দরবান। সেরা উপায় হলো বাসে করে যাওয়া, কেননা সময়টা বেশি লাগলেও একমাত্র বাস রুটেই ঢাকা থেকে সরাসরি বান্দরবান যাওয়া যায়। কল্যাণপুর, গাবতলী, কলাবাগান, মহাখালী, যাত্রাবাড়ি বা ফকিরাপুল থেকে পাওয়া যাবে বান্দরবানের বাস। কোম্পানি এবং সার্ভিস (এসি ও ননএসি) ভেদে এগুলোতে ভাড়া পড়তে পারে মাথাপিছু ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা।


যারা ট্রেনে ভ্রমণ করতে চান, তাদেরকে চট্রগ্রাম পর্যন্ত আসতে পারবেন, কারণ ঢাকা থেকে বান্দরবানের রেলপথ নেই। বিমান বন্দর অথবা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ধরা যাবে চট্রগ্রামের ট্রেন। এগুলোতে শ্রেণীভেদে মাথাপিছু ২৮৫ থেকে ৭৮৮ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নিতে পারে।


তবে দ্রুত ভ্রমণের জন্য সেরা উপায় হচ্ছে বিমানে করে যাওয়া। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানগুলো ১ ঘণ্টার মধ্যে চট্রগ্রামে নামিয়ে দেয়। এগুলোর টিকেট মূল্য জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৫০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ১৭৫ টাকা হতে পারে। অবশ্য নূন্যতম ১ মাস আগে থেকে টিকেট কাটা হলে দাম আরেকটু কম পাওয়া যেতে পারে।


ট্রেন বা বিমান যে পথেই আসা হোক না কেন, চট্টগ্রামে পৌঁছার পর দামপাড়া বাস স্ট্যান্ড বা বিআরটিসি টার্মিনাল থেকে উঠে পড়তে হবে বান্দরবানের বাসে। এই লোকাল বাসগুলোতে প্রতিজনের জন্য ২২০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া পড়তে পারে।


বান্দরবান পৌঁছার পর অবশেষে পাওয়া যাবে চিম্বুকের গাড়ি। জেলা সদর বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি, জিপ কিংবা চাঁন্দের গাড়িগুলো প্রায় দেড় ঘণ্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। পুরো চাঁন্দেরগাড়ি ভাড়া নিতে পারে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। রিজার্ভে যাওয়ার সুবিধা হচ্ছে যাত্রাপথে বিভিন্ন স্পটে নেমে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে নেওয়া বা ছবি তোলা যায়।


এখানে যে বিষয়টি মনে রাখা জরুরি, তা হলো- বিকাল ৪ টার পর থেকে চিম্বুক-থানচি রুটে কোনও গাড়ি চলাচলের অনুমতি নেই। তাই এই সময়টিকে মাথায় রেখেই চিম্বুক ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে হবে।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com