ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের সাহস ও অনুপ্রেরণার দিন
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১৮:২০
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের সাহস ও অনুপ্রেরণার দিন
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বছরের পরিক্রমায় বাঙালির জাতীয় জীবনে এই দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অনবদ্য। বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, মুক্তির চেতনা ও জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হয়েছিল, সুদীর্ঘকালের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, জেনেছিল লড়াই করে হলেও টিকিয়ে রাখতে হবে নিজস্ব স্বকীয়তায়- সেই দিন আজ। আর এই দিনের ঐতিহাসিক রচয়িতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু বাঙালি জাতি নয়, বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তির প্রেরণা হয়ে আছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পড়ন্ত বিকেলে সমবেত দশ লাখ মানুষকে সামনে রেখে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’


বিশিষ্টজনদের মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর দেশে দেশে নির্যাতিত নিপীড়িত, উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির প্রেরণা। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তিনি এই ভাষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। একইসাথে ৭ মার্চের ভাষণ থেকে একটি জাতির সৃষ্টি হয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। যাদুকরী এই ভাষণ আজ বিশ্বময় মুক্তিকামীদের অনুপ্রেরণা।
মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে সেদিন বঙ্গবন্ধু যেমন বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরেছেন, তেমনি দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এককথায় বলা যায়, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল। একইসাথে, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ যুদ্ধ দিনে মুক্তিসেনাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আজও সেই ভাষণ উজ্জীবিত করে চলেছে বাঙালি জাতিসহ বিশ্বব্যাপী সকল মুক্তিকামীকে।


বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অমর ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।


দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাজনীতির কালজয়ী মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ভাষণের মাধ্যমে দেশের শাসনভার জনগণের হাতেই তুলে দেন। ক্ষমতাকে কী করে নিয়ন্ত্রিতভাবে সকলের কল্যাণে ব্যবহার করতে হয়, তা–ও বুঝিয়ে দেন। শিখিয়ে দেন আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধক সমরনীতি, যুদ্ধকালীন সরকারব্যবস্থা এবং অর্থনীতি।’


একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় চিন্তা, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়- তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।


আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি বিবার্তাকে বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি জাতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যে বিখ্যাত ভাষণগুলো রয়েছে- ইউনেস্কো-জাতিসংঘ স্বীকৃত, তার মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণটি সর্বশ্রেষ্ঠ। বিখ্যাত ভাষণগুলোর মধ্যে মার্টিন লুথার কিং-এর ভাষণটি ছিল আই হ্যাভ এ ড্রিম, তার স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষা। বর্ণবাদ নিরসনের আন্দোলনে মার্টিন লুথার কিং যে ভাষণ দিয়েছেন সেটি বিশ্বে শ্রেষ্ঠ ভাষণের তালিকায়। আবার, আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণটি সেটিও শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই ভাষণগুলোর মধ্যে কোনোটি কিন্তু কোনো জাতির সৃষ্টি করেনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে একটি জাতির সৃষ্টি হয়েছে, সেই দিক থেকে এই ভাষণটি পৃথিবীর সকল ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।


তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষদের কাছে এটা সবচেয়ে আশার বাণী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ বাঙালি জাতি দীর্ঘ দিন নির্যাতিত নিপীড়িত ছিল, দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত পর্যায় এসে তাদের মুক্তির পথকে সুগম করেছে এই ভাষণ। সেই হিসেবে বলা যেতে পারে পৃথিবীর সকল নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের জন্য এটি অনুপ্রেরণার। সর্বোপরি এক শব্দে বলা যায় এই ভাষণ পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।


বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এর সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বিবার্তাকে বলেন, ৭ মার্চ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমরা সকলেই জানি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে বাঙালি তার অধিকারের জন্য লড়াই করেছে।


শোষণ নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখবার জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দাবিয়ে রাখার জন্য ষড়যন্ত্রের পথে এগোয়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মতামত না নিয়েই অধিবেশন স্থগিত করা হয়। উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলা। যখন পুরো দেশ উত্তাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, কীভাবে লড়াই করতে হবে সেটারও একটি দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি মূলত অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন ৭ মার্চ, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ মার্চ দিয়েছিলেন।


তিনি আরো বলেন, এই যে ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', এর মধ্য দিয়ে তিনি শুধু অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীর দেশে দেশে নির্যাতিত নিপীড়িত, উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির অনুপ্রেরণা। ৭ মার্চের এই ভাষণ জাতিসংঘের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই ভাষণ যতদিন পঠিত হবে, ততদিন এর নতুন ব্যাখ্যা নতুন ব্যঞ্জনা আমাদের কাছে ধরা দিবে।


বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল বাংলাদেশের মুক্তি প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক আহ্বান। যদিও এটি সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না, যেটি পরবর্তীতে ২৬ মার্চ অর্থাৎ ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে সর্বাত্মক লড়াইয়ের যে আহ্বান ছিল তাতে স্বাধীনতার মুখে যে অভিযাত্রা সেটি স্পষ্ট হয়। ৭ মার্চ তিনি কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তার কারণ তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হতেন যদি ৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো জানতেন তিনি বাঙালির নির্বাচিত নেতা।


৭ মার্চের ভাষণে লড়াইয়ের যে আহ্বান ছিল, সেই আহ্বানেই সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ হয়। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে সমন্বিত করেছেন, গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তিনি এই ভাষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।


তিনি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা আঞ্চলিক, কথ্য, চলিত ভাষা ব্যবহার করেছে, এতেই বোঝা যায় তিনি যে বাঙালির প্রাণের মানুষ। এই ভাষণের মধ্যে ভাষার শৈলী ছিল, রাজনীতি ছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছিল, সমাজচেতনা ছিল, আর তাই এই ভাষণ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।


বিবার্তা/এসবি/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com