বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল : কমিশনে জিম্মি ডাক্তাররা!
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৩৬
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল : কমিশনে জিম্মি ডাক্তাররা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে একের পর এক মোটরসাইকেল! দেখে মনে হতে পারে এটি হয়তো কোনো মোটরসাইকেলের শো-রুমের দৃশ্য!


কিন্তু না! সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে ভিন্নভাবে ভাবতে আপনি বাধ্য, বরং একদমই পাল্টে যাবে আপনার ভাবনা। কেননা, সেখানে মোটরসাইকেলে বসে থাকেন কিংবা সেই স্থানে পায়চারি করেন এমন কিছু মানুষ, যাদের গেটআপ দেখলে ধারণা বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।


তাদের কেউ এখানে খোশগল্পে ব্যস্ত, আবার কেউবা মেডিক্যালের ভেতর থেকে কাউকে আসতে দেখলে আগ বাড়িয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করেন। এদিকে তাদের এই কাজে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হলেও নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে, কতকটা যেন নিরুপায় হয়ে কিছুই বলতে পারেন না।



বলছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এই হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ১ ও বহির্বিভাগ ২-এর মাঝখানের রাস্তার দৃশ্য এটি। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের (এমআর) দৌরাত্ম্যে দিন দিন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।


সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত বহির্বিভাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে অবস্থান করে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তাদের লক্ষ্য থাকে রোগীর হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ডাক্তার কোন কোম্পানির ওষুধ লিখেছেন সেটা চেক করা। আর এটা করার জন্য রোগীরা চিকিৎসা শেষে কক্ষ থেকে বের হলেই ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, রোগীর জরুরি মুহূর্তও আমলে নেন না তারা। শুধু তাই নয়, রোগী কিংবা তাদের স্বজনদের বিরক্তি বা রোগীর প্রাইভেসি নষ্ট হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। অন্যদিকে হতদরিদ্র,অশিক্ষিত রোগী পেলে তো কথাই নেই। ইচ্ছামতো প্রেসক্রিপশন উল্টেপাল্টে দেখেন তারা।


বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের এই স্থানে কথা হয় ভুক্তভোগী রোগী আনিসের সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, যার রোগ হয়েছে সে বুঝে এটা নিয়ে তার কেমন চাপ কাজ করে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা? মেডিক্যালে এসে সিরিয়ালসহ এমনিতে নানা ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। এর উপর বাড়তি ভোগান্তি ওষুধ কোম্পানির এমআরদের নানা বাড়াবাড়ি! মানুষ যেখানে রোগের চিকিৎসা করাতে এখান থেকে ঐখানে, নানা দৌঁড়াদৌঁড়িতে ব্যস্ত সেখানে তারা আছে প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার কাজে! এই কাজে সাধারণ মানুষ চরম বিরক্ত হলেও অনেক সময় তাদের তেমন কিছু করার থাকে না।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফিরোজ আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, আমি একদিন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে ডাক্তার দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বের হলাম। আর বের হয়েই নিচে নামতেই আমাকে কয়েকজন এমআর ধরলো। তারা আমার প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলতে চাইলো। আমি দিলাম না। কিন্তু এরপরেও তারা জোর করতেই চাইলো আর বললো, জাস্ট একটা ছবি তুললেই তাদের কাজ শেষ। এরপরেও আমি তাদের দিলাম না। তবে এটা দেখলাম সহজ সরল মানুষ পেলে নয়-ছয় বুঝিয়ে তারা নিজেদের কাজটা করে নেয়।


ক্ষোভ প্রকাশ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, ডাক্তারিকে মহান পেশা বলা হলেও এখনকার অধিকাংশ ডাক্তারই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তারা ওষুধ কোম্পানির কমিশনের কাছে অনেকটা জিম্মি। ফলে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি হলো, কী হলো না সেটা নিয়ে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। তবে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় এই বিষয়টার পরিবর্তন অতীব জরুরি।



এমআরদের এই ভোগান্তি সৃষ্টি করার বিষয়ে স্কয়ার কোম্পানির এমআর আশফাক হোসেনের সাথে বিবার্তার কথা হয়। তিনি বলেন, আমরা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি সৃষ্টি করি না। তবে একটু খোঁজ খবর রাখি আর কী! আর এটা আমাদের চাকরির প্রয়োজনে করতে হয়।



ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এমআর সজল কুমার বিবার্তাকে বলেন, এটা তো ওপেন সিক্রেট বিষয় অনেক ডাক্তার ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন নিয়ে থাকে। আর এটা করলে কোম্পানি তো চাইবে ঐ ডাক্তার তাদের ওষুধ লিখে কিনা সেটা চেক করতে। এজন্য আমাদের দিয়ে এই কাজ করানো হয়।



তথ্যসূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে প্রতি সপ্তাহের দুইদিন নির্দিষ্ট সময় চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে প্রায় প্রতিদিনিই হরহামেশা চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করছেন তারা। মাঝেমধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন চিকিৎসকের চেম্বারের সামনেও তাদের অবস্থান করতে দেখা যায়। এছাড়া অনেক চিকিৎসক দীর্ঘসময় তাদের সঙ্গে আড্ডা ও খোঁশগল্পও করেন।



নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের এক আনসার সদস্য বিবার্তাকে বলেন, ওষুধ কোম্পানির এমআরদের সাথে আনসার থেকে শুরু করে উপর মহল পর্যন্ত ভালো সম্পর্ক। তাছাড়া অনেক ডাক্তারও চায় তারা আসুক। ফলে এভাবে লিয়াজো করে এই কাজ চলছে।



ওষুধ কোম্পানির সাথে ডাক্তারদের লিয়াজোর কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হওয়ার বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সাবেক ডিন ড. আ ব ম ফারুক বিবার্তাকে বলেন, কোম্পানি তাদের প্রোডাক্টের প্রচার ডাক্তারের কাছে গিয়ে করতেই পারে। তবে সেটার সিস্টেম থাকতে হবে। যথেচ্ছাভাবে করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করা মোটেও কাম্য নয়। অনেকগুলো হাসপাতাল এটা থেকে উত্তরণে ওষুধ কোম্পানির এমআরদের জন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু সেই আইন না মানলেও তো অবশ্যই বিশৃঙ্খল হবেই। আমি মনে করি এই বিষয়ে একটি সুষ্ঠু সুরাহা হওয়া ‍প্রয়োজন।


এদিকে ওষুধ কোম্পানি থেকে অর্থ ও মাসোহারা নেয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকদের ভাবা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, আমি সবার সামনে বিস্তারিত কিছু বলবো না। শুধু বলবো, এটা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। ৮ অক্টোবর, রবিবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন।


শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ওষুধ কোম্পানি কিন্তু প্রতিবছর কম টাকা দিচ্ছে না। এই টাকাগুলো কী ফর্মে দিচ্ছে, চিকিৎসকরা কী ফর্মে নিচ্ছেন, আর কী ফর্মে নেয়া উচিত। আমি এখানে আর বিস্তারিত বলবো না। দয়া করে আপনারা এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু ভাববেন।


সার্বিক বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, তাদের (এমআর) তো এভাবে রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা বসে থাকার কথা না। তাদের সাথে তো আমাদের কথা আছে সপ্তাহে ১/২ দিন দুপুর ১/২ টার মধ্যে শুধু প্রোডাক্ট নিয়ে ডাক্তারদের সাথে কথা বলতে পারবে। কিন্তু এভাবে বিকাল, সন্ধ্যা অবধি দাঁড়িয়ে থেকে রোগীদের বিরক্ত করা খুবই অপছন্দীয় কাজ। আর এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এই বিষয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com