অপেক্ষার প্রহর শেষ, রাত পোহালেই উদ্বোধন শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ২২:১৭
অপেক্ষার প্রহর শেষ, রাত পোহালেই উদ্বোধন শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

অপেক্ষার প্রহর শেষ, রাত পোহালেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দেশের বৃহৎ মেগাপ্রকল্প হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিক অংশ।


উদ্বোধন উপলক্ষে তৃতীয় টার্মিনালে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমানচালক ও সংশ্লিষ্টরা এই উদ্দীপনাপূর্ণ মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন।


জমকালো আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শনিবার, ৭ অক্টোবর সকাল ১০ টায় তৃতীয় টার্মিনাল আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অন্যতম এই মেগাপ্রকল্পের কাজের অগ্রগতি এগিয়েছে দ্রুত গতিতে।


বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। বাকি ১০ শতাংশ কাজ শেষ হলে যাত্রীসেবার মান আমূল বদলে যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।



বিশ্বের সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এই টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে যাত্রী সেবা, সব কিছুই হবে আন্তর্জাতিক মানের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের এভিয়েশন খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে তৃতীয় এই টার্মিনাল।


সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মূল অবকাঠামো এখন প্রস্তুত, চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ভবন নানা রকম নকশায় সাজানো হয়েছে। টার্মিনালের মূল ভবন ও পাশেই চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি হিসেবে নানান মহড়া। টার্মিনালে এখনো কাজ করছেন নির্মান শ্রমিকরা চলছে বিভিন্ন নির্মাণকাজ। এক হাজার ৪৪ টি গাড়ি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বহুতল কার পাকিং তৈরির কাজ চলছে। পাকিং সুবিধার জন্য তৃতীয় টার্মিনালের সাথে বহুতল কার পাকিং ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের জন্য করা হচ্ছে বিশেষ সুবিধা। অন্যান্য দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য কাস্টমসের জন্য একটি হল ও ছয়টি চ্যানেল থাকবে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হচ্ছে।



বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সুইস এয়ার, এয়ার কানাডা, এয়ার ফ্রান্সসহ অন্তত ১৫টি নতুন বিদেশি এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।


বেবিচকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তৃতীয় টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে যাত্রীদের নির্বিঘ্নে বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া ও ভ্রমণের সুযোগ করে দেবে। এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, ডেরুম, মুভি লাউঞ্জ, শিশুদের জন্য প্লে-জোন এবং ফুড কোর্ট যাত্রীদের চাহিদা ও স্বাচ্ছন্দ্য পূরণ করবে।



বেবিচক সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে নির্মাণকাজ শুরু হয়। মাত্র তিন বছর পর উদ্বোধন হচ্ছে প্রকল্পটি। নকশা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষে চালু হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বর্তমান বিমানবন্দরের চেয়ে সক্ষমতার বাড়বে আড়াই গুণ। ফলে তিনটি টার্মিনাল দিয়ে বছরে শাহজালালের যাত্রী পারাপারের সক্ষমতা ৮০ লাখ থেকে বেড়ে ২ কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে। দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালে বর্তমানে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এই দুটি টার্মিনাল ১ লাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। তৃতীয় যে টার্মিনালটি হচ্ছে, সেটি বর্তমান দুটি টার্মিনালের দ্বিগুণের বেশি। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রায় ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে এই থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে। অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। লাগেজ হ্যান্ডেলিংয়ের ক্ষেত্রে মনুষ্য সৃষ্ট অব্যবস্থাপনার কোনো সুযোগ নেই। স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে এটি। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও থার্ড টার্মিনাল নির্মাণকাজও চলেছে বিরতিহীনভাবে। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জি-৭ রাষ্ট্রগুলো থেকে অত্যাধুনিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। ১৬ মিলিয়ন যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই টার্মিনালে লাগেজ হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে প্রাইভেট পার্টনারশিপ হিসেবে বিদেশি একটি দক্ষ সংস্থাকে। কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করবে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। সেখানে একটি আধুনিক মনিটরিং রুমও থাকছে। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সব সংস্থার কর্মকর্তারা এই কন্ট্রোল রুম থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন এবং সরেজমিনে মনিটরিং করতে পারবেন।



সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করেছি। ইতোমধ্যে থার্ড টার্মিনালের কাজ ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে। যা সম্ভব হয়েছে প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃসাহসিক ও দূরদর্শী ভূমিকার জন্য। এর ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা প্রকল্প উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। আগামী ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থার্ড টার্মিনালের শুভ উদ্বোধন করবেন।



তিনি বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তিন তলাবিশিষ্ট তৃতীয় টার্মিনালে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক ইকুইপমেন্ট । যাত্রীদের জন্য থাকছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও প্রয়োজনীয় কাজ চলছে। এই টার্মিনাল দেশের অ্যাভিয়েশন খাতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।



বেবিচক সূত্র আরও জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে চারটি ট্যাক্সিওয়ে আছে। নতুন করে আরও দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সে জন্য নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন।


বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, থার্ড টার্মিনালে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ। প্রথম ধাপে চালু করা হবে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ। থাকবে উড়োজাহাজ রাখার জন্য ৩৬টি পার্কিং বে। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেকইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেকইন কাউন্টার থাকবে। এছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ থাকবে ৬৬টি ডিপারচার ইমিগ্রেশন কাউন্টার। আগমনের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেকইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেকইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। এর বাইরে টার্মিনালে ১৬টি আগমনী ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে মালটিলেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ১ হাজার ২৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। থার্ড টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ ও উড়ালসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগব্যবস্থা থাকবে। এতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। থার্ড টার্মিনালে স্বতন্ত্র কোনো ভিভিআইপি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে না। তবে টার্মিনাল ভবনের ভেতরে দক্ষিণ পাশে সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ভিভিআইপিদের সময় কাটানোর জায়গা থাকবে।


বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করছে স্যামসাং গ্রুপের কন্সট্রাকশন ইউনিট স্যামসাং কনস্ট্রাকশন এবং ট্রেডিং (সিঅ্যান্ডটি) করপোরেশন। অত্যাধুনিক নির্মাণ কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন আকর্ষণীয় নির্মাণ সাফল্যের বিস্তৃত পোর্টফোলিও তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে, প্রতিষ্ঠানটি প্রকৌশল ও নির্মাণসংস্থা হিসেবে বিভিন্ন খাতে নিজেদের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করেছে। স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন উঁচু ভবন থেকে বিমানবন্দর, চিকিৎসা সুবিধা, অগতানুগতিক ভবন এবং অত্যাধুনিক উৎপাদন সুবিধাসম্পন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে সক্ষম। বুর্জ খলিফা, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, তাইপে ১০১, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনাল, দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আবুধাবির ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকসহ আরও অনেক কিছুর সফল নির্মাণ করেছে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন।



দেশের বৃহৎ এই টার্মিনালের ভেতরের ভবনটির নকশা তৈরি করেছেন বিখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিন। তিনি সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৩, চীনের গুয়াঞ্জুর এটিসি টাওয়ার ভবন, ভারতের আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের নকশা তৈরি করেন।


২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় একনেক। নির্মাণ কাজে অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বৃহৎ এই থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পটির ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে অবশ্য প্রকল্প ব্যয় ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। যার আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় ২১ হাজার ৪০০ কোটি। টার্মিনালটি নির্মাণে ৫ হাজার কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার এবং নির্মাণ ব্যয়ের বাকি অংশ আসবে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা'র (জাইকা) তহবিল থেকে। টার্মিনালটি নির্মাণে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন ৫ হাজার কোটি টাকা (১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার) টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। অত্যাধুনিক এই টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বছরে প্রায় ২ কোটি যাত্রী এটি ব্যবহার করতে পারবেন।



নতুন টার্মিনালে ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য একটি বড় লাউঞ্জ বছরে ৪০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেবে।


প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে দুটি পুরানো টার্মিনালের সাথে নতুন টার্মিনালকে সংযুক্ত করার জন্য একটি করিডোর নির্মাণ করা হবে।


মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ ভূগর্ভস্থ টানেল ও ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে যাতায়াতের সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।



বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com