সড়কে অব্যবস্থাপনা; রাজধানীতে যানজট
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৫৮
সড়কে অব্যবস্থাপনা; রাজধানীতে যানজট
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

যানজট নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারীদের। একটি শহর কীভাবে দিনের পর দিন স্থবিরতার দিকে যাচ্ছে, মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে- ঢাকা তার অন্যতম উদাহরণ। ঢাকা শহরে উড়ালসড়ক, সড়ক সম্প্রসারণ, সংস্কারকাজসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান আছে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে তীব্র যানজটে নাকাল হচ্ছে মানুষ।


ঢাকায় যানজট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও যানজটের তীব্রতা বেড়েই চলছে। সড়ক অনুযায়ী যানবাহনের নির্ধারিত কোনো গতি নেই। ত্রুটিযুক্ত যানবাহন চলাচল, প্রয়োজন অনুযায়ী জেব্রাক্রসিং, গতিরোধক, ফুটওভার, উন্নত সিগন্যালিং ব্যবস্থা, রেলগেট, ফুটপাত ইত্যাদির অভাব রয়েছে প্রকট। ঢাকার রাস্তায় বেরুলেই ভিন্ন গতির নানান পরিবহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল লক্ষ্য করা যায়।



বিশ্বের সব দেশে দুর্ঘটনা রোধ, যানজট নিরসনে রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে আইন-কানুন আছে- যা চালক, যাত্রী, পথচারী সবাই মেনে চলতে বাধ্য। আমাদের দেশেও তা আছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে যে কারো মনে সংশয় সৃষ্টি হতে পারে- আসলেই এখানে কোনো সড়ক পরিবহন আইন আছে? এসব আইন বা নিয়মকানুন কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই।



সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগে দেখা যায়, সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন ৭ জন ট্রাফিক পুলিশ ও তার পাশাপাশি আনসার সদস্যসহ কিছু সেচ্ছাসেবী সদস্য। প্রতিটি সড়কের মাঝখানে ট্রাফিক পুলিশ দুহাত দিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিভিন্ন যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল, রিকশাচালকরা কোনো নিয়ম মানছেন না। যে যে ভাবে পারছেন ট্রাফিক পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিয়ম না মেনেই চলছেন। মাঝে মধ্যে জরিমানা করলেও বিশৃঙ্খলা ঠেকানো যাচ্ছে না। রাজধানীর সড়কে এমন বিশৃঙ্খলা এখন নিয়মিত ঘটনা। যার ফলে ঘটছে দুর্ঘটনাও।



শাহবাগের প্রতিটি সড়কের মুখে আইনশৃংখলা বাহিনী কাজ করলেও বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ওভারটেকিংয়ে সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। আবার সঠিক স্থানে ফুটওভারব্রিজ না থাকায় জনসাধারণকে সড়ক পার হতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে।



পথচারী মো. মকলেছুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, নিদির্ষ্ট স্থানে ফুটওভারব্রিজ নেই, মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বাধ্য হয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। ঢাকা শহরের জায়গার তুলনায় মানুষ ও যানবাহন অনেক বেশি। আবার রাস্তার সংখ্যা কম। রাস্তা থাকলেও তার একটা অংশে গাড়ি পার্কিং করে রাখা মোটরসাইকেল ও রিকশার জটলা তো আছেই। অনেক রাস্তায় আবার নির্মাণ কাজ চলছে, যার কারণে রাস্তা কমে গেছে। হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে হচ্ছে।


তিনি বলেন, চালকরা কোনো নিয়ম মানতে চায় না। ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশ মানে না। ট্রাফিক পুলিশ একা এর সমাধান করতে পারবে না। সবার আগে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। রাস্তার সকল নিয়ম মানতে হবে। তবেই রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরবে, তাছাড়া সম্ভব না।


বিহঙ্গ পরিবহনের চালক মো. তারিকুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, রাস্তাতে অনেক জাম- এই সিগন্যালে এক ঘন্টা থাহি বসি আছি। শাহবাগের এই সিগন্যাল ট্রাফিক পুলিশ ছাড়েই না। সব লাইনের গাড়ি ছাড়ে কিন্তু এই লাইন ছাড়ে না। কতখন বইয়ে থাকতে হব বুঝতেছি না। জামে যাত্রীরা নামি হাঁটা শুরু করছে। গাড়ি বাড়ছে, মানুষ বাড়ছে- তাই জ্যামও বাড়ছে।


শাহবাগ সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা পাওয়ার সাথেই সব গাড়িগুলো বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের সামনে গিয়ে যাত্রী নেয়ার জন্য দাঁড়ায়। এতে কিছু গাড়ি সিগন্যাল অতিক্রম করলেও অনেক গাড়ি মোড়ে আটকে যায়। তৈরি হয় যানজটের। ট্রাফিক পুলিশ দৌড়ে বাসের গায়ে আঘাত করে সড়ানোর চেষ্টা করছে। সেখানেই এয়ারপোর্টগামী একটি বাস যাত্রী তুলছিল। ওই বাসের চালক নুর মোহাম্মদের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, এখানে না দাঁড়ালে যাত্রী পামু কই। তেলের টেকাই উডে না। আবার পুলিশ মামলা দিছে, কি করমু আননে কন। খাওয়ন তো লাগব। সবকিছুর দাম বাড়ছে। এহান তে যাত্রী নিতে না পারলে রাস্তাত আর পাওয়া যাবো না, তাই গাড়ি দাঁড় করাইছি।


সেখানেই রাস্তার এক পাশ দিয়ে লাইন করে মোটরসাইকেল রেখে চালকরা উৎপেতে আছেন। কাছে যেতেই একজন বললেন ভাই কই যাবেন? কথা হয় মোটরসাইকেল চালক কামরুল হাসানের সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমরা আর কোথায় দাঁড়াব। আমাদের জন্য কোন জায়গা নেই, এমনকি বাস থামানোর কোনো জায়গা নাই। এ শহরে কোনো কিছুর জন্য কোনো ব্যবস্থা নাই। মানুষ কি করবে, কোথায় দাঁড়াবে কোন দিক দিয়ে হাঁটবে- কোন জায়গা নাই।


এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বিবার্তাকে বলেন, আমরা একটানা আট ঘন্টা সড়কে কাজ করি। কত ধরনের ঝামেলার মোকাবিলা করতে হয়। কত মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। সারাদিন ধুলাবালু, শব্দের মধ্যে থাকতে হয়। গাড়ির চালকরা অযথা হর্ন বাজাতে থাকেন। এখন কানে অনেক সময় কম শুনি, চোখে কম দেখি, শ্বাসকষ্ট হয়।


তিনি বলেন, সড়কে অনেক চালক নিয়ম না মেনেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। অনেককে আবার কাগজপত্র দেখে মামলাও দেওয়া হয়, রেকার করা হয়। তারপরও সড়কে বিশৃঙ্খলা কমানো যাচ্ছে না। চালক, পথচারী থেকে শুরু করে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।



শুধু শাহবাগ সড়কেই এমন পরিস্থিতি তা নয়। রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, প্রেসক্লাব, নিউমার্কেট, সাইন্সল্যাব, বাংলামোটর, কারওয়ানবাজারসহ বেশিরভাগ সড়কে একই চিত্র দেখা যায়।



এ নিয়ে ডিএমপি রমনা জোনের ডিসি জয়নুল আবেদীনের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, আমাদের যে ট্রাফিক রুলস আছে সেটা যদি কেউ না মানেন সব জায়গায় সার্জেন্ট আছে তারা ট্রাফিক আইন মেনে মামলা দেয়। যদি চালক কোথাও ট্রাফিক সিগন্যাল না মানে, তাহলে কর্তব্যরত পুলিশ পরের স্টপেজে জানিয়ে দেয়। সেখান থেকে গাড়ি ধরে কাগজপত্র দেখে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। গাড়ি আটক করা হয়, মামলা দেয়া হয়। আমরা রমনা জোনে তিন হাজারের বেশি ভায়োলেশনের জন্য মামলা দিয়েছি। ৭ হাজার গাড়ি আমরা আটক করেছি, রেকার করেছি। এসব এখনো চলমান আছে।


তিনি বলেন, ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির ব্যবস্থাপনার কাজ সিটি করপোরেশনের হাতে। এটার একটা জরিপের কাজ চলছে। কারণ, একেক সময় একেক রাস্তায় গাড়ির প্রেসার একেক রকম হয়। একেক সময় একেক দিকের গুরুত্ব বাড়ে। সেভাবেই একটা ডেভোলপমেন্টের কাজ চলছে। এ নিয়ে একটা প্রজেক্ট চলমান আছে। বাংলাদেশ সরকার এ প্রজেক্টটি নিয়েছে, গবেষণা চলছে। এর বাস্তবায়ন হলে হয়ত আটো সিগন্যাল পদ্ধতিতে যাওয়া সম্ভব হবে।


গাড়ির গুরুত্ব ও রাস্তার গুরুত্ব বুঝে সিগন্যাল ছাড়া হয় বলে জানান ডিসি জয়নুল আবেদীন। মনে করেন একদিকে একশ গাড়ি আছে, অন্যদিকে এক হাজার গাড়ি আছে। তখন তো এক হাজার গাড়ি যেদিকে আছে, জনগণ যেহেতু বেশি তাই এদিকে একটু গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়। এজন্য হয়তো মানুষের কাছে এমন মনে হতে পারে। আমরা তো রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে সকল ট্রাফিক চ্যানেলে কথা হয়। কোনদিকে কতটা গাড়ি আছে, সেগুলোর গুরুত্ব বুঝে সিগন্যাল ছাড়া হয়।


রাস্তায় গাড়ি পার্কিং নিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেন, আসলে রাস্তাটা সিটি করপোরেশনের। মূল সমস্যা হচ্ছে ঢাকা শহরে কোন পার্কিং ব্যবস্থা নেই। স্কুল-কলেজ, মার্কেট, হাসপাতাল কোথাও নেই পার্কিং ব্যবস্থা। ঢাকার নিউ মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড থেকে শুরু করে বেশিরভাগ মার্কেটে পার্কিং নাই। এখন এ গাড়িগুলো যাবে কোথায়, সবাই তো এদেশের মানুষ। আমরা আসলে অসহায় হয়ে যাই, আমাদের শহরে কী হচ্ছে সবাই জানে। এসব নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, কিভাবে ডেভেলাপ করা যায় ন্যশনাল পর্যায়ের একটাল সিদ্ধান্তের বিষয়।


সড়কে শৃংখলা ফেরানো শুধু ট্রাফিক পুলিশ কাজ নয় জানিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেন, সম্মলিত প্রচেষ্টায় রাজধানী ঢাকাকে ভালো করতে হবে।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com