সওজ-এর দুর্নীতিবাজরাই আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ঢাল
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:২০
সওজ-এর দুর্নীতিবাজরাই আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ঢাল
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন নামে ঢাকার একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বড় প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেয়া, টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বড় বড় প্রকল্পে কাজ করার অভিযোগ ওঠে। গত বছর অক্টোবরে এসব অভিযোগ তদন্ত করে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগকে নির্দেশনা দেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।



নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা না দেয়ায় সড়ক বিভাগকে মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার তাগাদা দেয়া হয়। তবে এতেও সাড়া দেয়নি সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রতিবেদন চাওয়ার অন্তত তিন মাস পার হলেও এখন তা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেনি।



সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠ পর্যায় থেকে সব প্রতিবেদন এখনো আসেনি। আর যেসব প্রতিবেদন এসেছে তা থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর মতো তেমন কিছুই নেই। এদিকে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা হওয়ার কথা থাকলেও জমা হয়েছে কি-না জানেনই না সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী।


সূত্রে জানা গেছে, আবেদ মনসুরকে রক্ষা করতে সওজের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তাদের মদদেই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই সড়ক বিভাগের কাজ বাগিয়ে নেয় আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমার সময় পেছাচ্ছে এই অসাধু চক্রটি।



সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ‘আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন গত ৩ বছরে ভুয়া ও অসত্য তথ্য দিয়ে কাজ পাওয়ায় আর্থিক দুর্নীতি তদন্ত ও জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান’- এমন বিষয় উল্লেখ করে গত বছরের ১৮ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. দেলোয়ার হোসেন একটি চিঠি ইস্যু করেন। আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিষয়ে তদন্ত করে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন তিনি।



এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (কানেক্টিভিটি শাখা) মো. দেলোয়ার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমাদের কাছে এখনো প্রতিবেদন এসে পৌঁছেনি। সময়মতো দিতে না পারায় আমরা রিমাইন্ডার দিয়েছি।


এর আগে মন্ত্রণালয় থেকে এই চিঠি ইস্যুর সাতদিন পর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ দেশের ১১টি সওজ জোন, তিনটি উইং, সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশনা দেন।


এ বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলে মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, ফিল্ড থেকে তথ্য আসে না। যা এসেছে আমরা রেডি করে রেখেছি। বাকিগুলো ফিল্ড থেকে আসলে পাঠিয়ে দিব।


তিনি বলেন, যেসব প্রতিবেদন এসেছে তা থেকে রিপোর্ট করার মতো তথ্য নেই। ম্যাক্সিমাম বলেছে (সওজ জোন) তার (আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের) কোনো কাজ নেই। যার কারণে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়ার মতো কোনো তথ্য নেই।


জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বিবার্তাকে বলেন, একই ঘটনা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ওরা একটা রিপোর্ট করতেছে। ওটা চলমান আছে। জোন থেকে ওখানে পাঠাচ্ছে।


সওজ থেকে কোনো প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে কি-না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো আমি আসার আগের ঘটনা। পাঠাইছে কি না জানি না। জোন থেকে মনে হয় ওরা পাঠাচ্ছে।


এদিকে ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. মাহবুবের রহমান সড়ক বিভাগের ৯টি জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে সড়ক জোনের আওতায় আহ্বানকৃত দরপত্রে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন কর্তৃক দরপত্র দাখিল করা হয়ে থাকলে সেগুলো কিভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে/মূল্যায়নকালে কম্পলিশন সার্টিফিকেট যাচাই করা হয়েছে কি-না ইত্যাদি বিষয়ে মতামত তিন কার্যদিবসের মধ্যে সরাসরি প্রেরণের নির্দেশনা দেন।


জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, যখন চিঠি দেয়া হয়েছিল তখন আমার জোনে টেন্ডার ছিলো না। আমরা জবাব দিয়ে দিয়েছি।


সওজ রাজশাহী জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাদেকুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, আমরা চিঠির জবাব দিয়ে দিয়েছি।


সওজ বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম আজাদ রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমার ধারণা দেয়া হয়ে গেছে। না দিলে দিয়ে দেয়া হবে।


সওজ খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী বিবার্তাকে বলেন, আমাদের এখানে পেন্ডিং কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। এছাড়া সবাইকে চিঠি দিয়ে বলে দিয়েছি ভ্যারিফাই না করে কাজ দেয়া যাবে না।


সওজ সড়ক সার্কেল (চট্টগ্রাম) এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমাদের প্রতিবেদন আমরা দিয়ে দিয়েছি।


এদিকে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন টেন্ডার পেতে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহার করছে, এমন তথ্যের বিষয়ে অন্তত এক বছর আগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করেন। কিন্তু তারপরও কোনো এক আজানা কারণে কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।


২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি পৃথক দিনে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীগণ আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিলের অভিযোগে পৃথক দু’টি চিঠি ইস্যু করেন। ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে পাঠানো এসব চিঠির অনুলিপি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৗশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ দেশের বিভিন্ন জোন ও সার্কেলে পাঠানো হয়।


https://www.bbarta24.net/special-report/212978 (আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের একক রাজত্ব সড়ক বিভাগে- লিংকে নিউজের সম্পূর্ণ অংশ)


চিঠিগুলোতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট (সমাপনী সনদ) দাখিল করে ফ্রডুলেন্স প্র্যাকটিস (প্রতারণামূলক অনুশীলন)-এর সমান শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে পিপিআর-০৮ এর বিধি অনুসারে এবং দরপত্রের শর্তানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কর্মকর্তারা সুপারিশ করেন।


এ নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি ‘আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের একক রাজত্ব সড়ক বিভাগে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে বিবার্তা। বিবার্তা অনুসন্ধানে জানা যায়, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন এখন পর্যন্ত স্বাক্ষর জাল করে শতাধিক কাজের ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট তৈরি করেছে। আর এসব ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে সওজের বড় বড় প্রকল্প হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগে শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকা সত্ত্বেও বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নিচ্ছে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।


শুধু সনদ জালিয়াতি নয়; টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও সড়ক ও জনপথের কিছু অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার যোগসাজশে কোনো ধরণের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বড় প্রকল্প পেতে কাজ না করেই কম্পলিশন সার্টিফিকেট (সমাপনী সনদ) জমা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাজ করার অভিযোগও রয়েছে।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com