বেঁচে থাকাটাই স্বপ্ন তাদের
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৩, ১৪:৩৪
বেঁচে থাকাটাই স্বপ্ন তাদের
ইবনুল কাইয়ুম
প্রিন্ট অ-অ+

ঝাপসা দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তার চাহনি। ক্ষরায় ফাটা ফসলের জমির মতো চামড়ার বলিরেখা। দেখে বয়স অনুমান করা মুশকিল। তবে ধারণা করা যায় ৯০ বছরের কম হবে না।


বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চলাচলে প্রায় অক্ষম একজন মানুষ। এদেশের অতি সাধারণ মানুষের ভিড়ে অনায়াসে হারিয়ে যাওয়া লাখো জনের একজন।


কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্বপাশের ওভার ব্রিজের সামনে বসে আছে। হাতে সাদা রঙের একটি প্লাস্টিকের বাটি। মাথাটি দম দেওয়া পুতুলের মতো সারাক্ষণই নড়ছে। আসা যাওয়ার পথে অনেকেই হাতের বাটিতে টাকা ফেলছে। দুই, পাঁচ, দশ কেউবা আরো বেশি। একটু বড় নোট বাটিতে পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে চালান হয়ে যাচ্ছে পাশে রাখা একটি ব্যাগে। তারমানে চোখের দৃষ্টি এখনো বেশ স্বচ্ছ।


বয়োবৃদ্ধা এই মানুষটি সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হলো। তার সঙ্গে দুয়েকটি কথা বললাম। দৃষ্টি যতোটা চলে, শ্রবণ শক্তি ততোটা প্রখর নয়। আমার প্রশ্নের জবাবে আগের মতোই মাথা নড়তে লাগলো তার, নির্বিকার।


বুঝলাম এভাবে কাজ হবে না। সাহায্যের আশায় এদিক সেদিক তাকালাম। বেশি খুঁজতে হলো না। জিআরপি থানার বারান্দার নিচেই পাওয়া গেল সাহায্যকারীকে। কথা বলতে চাইলে রাজ্যের সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।


উদ্দেশ্য মহৎ জেনে মুখ খুললেন। নাম রাশেদা খাতুন (৫৫)। বয়োবৃদ্ধা রহিমা খাতুনের মেয়ে। ইনিই রহিমার যাবতীয় দেখাশুনা করেন।


রহিমা খাতুনের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। এক মেয়ে ও এক ছেলে। সুখের সংসারই বলা যায়। একসময় ছিলও তাই। প্রায় ৩০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর চিত্র বদলে যায়। অসহায় হয়ে পড়েন সন্তানদের নিয়ে। সংগ্রাম শুরু হয়। জীবন সংগ্রামে নেমে প্রথমেই বেছে নেন কবিরাজি পেশা। তাতে কুলায় না। অন্যের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান, চাল, চিড়া ইত্যাদি কোটার কাজ নেন। ছেলে-মেয়ে বড় হয়। বিয়ে হয় মেয়ের।


এরই মধ্যে এক যায়গায় কবিরাজি করতে যান রহিমা। সেখানে রাতে ঘুমের মধ্যে খাট থেকে পড়ে যান। পড়েন ব্যবহৃত খড়মের উপরে। তাতে বাম কানে গুরুতর আঘাত পান। সেই আঘাত ধীরে ধীরে মারাত্মক হয়ে ওঠে। ডাক্তার দেখানোর সামর্থ ছিল না। নিজের কবিরাজিতে কিছুটা সেরে ওঠে। তবে মাথার বাম পাশ ফুলে ঢোল হয়ে থাকে। এক সময় সেটি ভাল হয়। তবে সেই থেকে অনবরত মাথা নড়া শুরু। ডানে বাঁয়ে দুলতে থাকে দম দেওয়া পুতুলের মতো।


একটু বড় হলে জন্ম থেকেই এক চোখ অন্ধ ছেলেটি রিকশা চালানো শুরু করে। বিয়ে হয়। একে এক সাত ছেলে-মেয়ের বাবা হন ছেলে আবুল কালাম। সংসারের বোঝা বাড়ে। সাথে বোঝার উপরে শাকের আঁটি হয়ে পড়েন বৃদ্ধা মা।


মেয়ে রাশেদার কোনো সন্তান নেই। স্বামী পরিত্যক্তা। একসময় মা-মেয়ে সিদ্ধান্ত নেন এলাকা ছাড়ার। এলাকার অন্যান্য ভিক্ষুকদের সঙ্গে একসময় চলে আসেন ঢাকায়। বসতি হয় কমলাপুরে। জিআরপি থানার বারান্দার নিচে চটের বিছানার সংসার হয় মা-মেয়ের।


বৃদ্ধা রহিমার খাদ্যের চাহিদা খুবই কম। প্রতি বেলায় সামান্য ভাতের সঙ্গে একটু দুধ ও মিষ্টি। এই হলো তার খাবার তালিকা। এখানে রান্না করতে দেয় না পুলিশ। তাই প্রতি বেলার খাবারই তাদের কিনে খেতে হয়।


প্রতিদিন রহিমা গড়ে পাঁচশ’ টাকা উপার্জন করেন। দৈনিক খাবার ও ওষুধ খরচ বাদে দুইশ’ টাকার মতো জমে। জমানো টাকা নিয়ে মাঝে মাঝেই গ্রামে বেড়াতে যান তারা। ছেলের সংসারে কিছুটা সাহায্য হয় তাতে। তাছাড়া বেশ কিছু জমানো টাকা কমলাপুরের এক ব্যবসায়ীকে দিয়েছেন তারা। নিতান্ত কম নয়, ১৭ হাজার। সাক্ষী ছিল জিআরপি থানার এক পুলিশ। সেই টাকা নিয়ে ব্যবসায়ী টালবাহানা শুরু করে। পুলিশের সহায়তায় ১২ হাজার উদ্ধার হয়েছে। বাকি আছে পাঁচ। সেটি উদ্ধার হলে বাড়ি যাবেন তারা। আর ফিরবেন না।


লাভজনক উপার্জন ছাড়বেন কেন? প্রশ্নটা করতেই একটু থমকালো রাশেদা। একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘বয়স বেড়েছে মায়ের। ইদানিং প্রায়ই অসুখ করছে। খরচ বাড়ছে। আগের মতো আর দিনব্যাপী বসে থাকতে পারে না। ঘন ঘন বিশ্রাম করতে হয়। উপার্জনও তাই কমছে।’


কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে, ছলছলে চোখে বলেন- ‘মায়ে আর বেশিদিন বাঁচব না’। লাশ বাড়িতে নেওয়া কঠিন। তাই এবার ঈদের পরে গেলে আর ফিরবেন না। ওখানে কষ্ট হবে। তবে নিজে অন্যের বাড়িতে কাজ করবেন। যে ক’দিন বাঁচে মাকে নিয়েই কাটাবেন।


ঈদের শাড়ি কেনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলাম। ব্যাথামিশ্রিত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। বুঝলাম হয়নি, হবেও না।


নিজে থেকেই আবার শুরু করলেন রাশেদা। বললেন, কমলাপুর স্টেশনের ঈদের দিনের কথা। এখানকার উদ্বাস্তুদের জন্য প্রতি বছর সরকার ঈদের আগে একটি নামের তালিকা তৈরি করেন। শাড়ি-কাপড়সহ সেমাই, চিনি দেওয়া হয়। কোরবানির সময় অনেকে মাংস বিলি করেন। বিতরণের দায়িত্বে থাকেন জিআরপির পুলিশেরা।


এই ক’বছরে মাত্র একটি শাড়ি পেয়েছেন রাশেদা। আর সেমাই, চিনি কখনোই না। মাংসও পাননি কখনো। তবে কারা পায় সেসব? জানালেন, যাদের সঙ্গে পুলিশের ভাব বেশি তারাই পায়। তবে এদের মধ্যে আবার কম বয়সী মেয়েদের অগ্রাধিকার বেশি! কখনই নাকি তালিকা অনুযায়ী বিলি বণ্টন হয় না। কখন বিতরণ হয়ে গেল অনেক সময় তারা জানতেও পারেন না।


এ ব্যাপারে মুখ খুললেন না জিআরপির কেউ। কেউ কিছু জানেন না এমন একটি উদাসীন ভাব নিয়ে রাজ্যের কাজে ব্যস্ত থাকলেন! কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম।


ঈদের দিন অনেকেই কমলাপুরে রান্নাকরা সেমাই বা খিচুড়ি-মাংস নিয়ে আসেন বিতরণের জন্য। তা নিয়ে সবসময়ই কাড়কাড়ি চলে। রাশেদার ভাষায় ‘হাভাতেদের’ সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা যায় না।


ভিক্ষাবৃত্তিতে জীবন ধারণ করলেও এখনো কিছুটা আত্মসম্মান বেঁচে আছে। বললেন, ‘যদি ভাগে পাই তাহলেই খাবো, না হলে না। কাড়াকাড়ি করে শকুনের মতো খেতে রাজি নই।’


আর দশদিনের মতোই কাটবে তাদের ঈদের দিনও। এ দিনটি আলাদা কোনো অর্থ বহন করে না তাদের জীবনে। আলাদা কোনো স্বপ্নও নেই। বেঁচে থাকাটাই একমাত্র স্বপ্ন তাদের।


এরই মধ্যে একটু কাশলেন রহিমা। শঙ্কিত চোখে সেদিকে চাইলেন মেয়ে রাশেদা। উঠে এগিয়ে গেলেন মায়ের দিকে। বুঝলাম সময় হয়েছে আমারও উঠে পড়ার। কিছুটা বেদনাহত, কিছুটা সহমর্মী হয়ে উঠে পড়লাম। তার আগে সাদা রঙের বাটিতে একটি নোট রেখে দিলাম সন্তর্পণে। ততোধিক সন্তর্পণে নোটটি চালান হয়ে গেল পাশের সেই প্যাকেটটিতে!


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com